রাজবাড়ী প্রতিনিধি:
গরিব পরিবারে অসুস্থ্ স্বামীর দেখভাল, দুই সন্তান ও শ্বশুর-শাশুড়িসহ ৬ সদস্য নিয়ে সংসার এ্যানী আক্তারের। অসুস্থ শরীর নিয়ে স্বামী প্রতিদিন স্বাভাবিক কাজ করতে পারেন না, সেই সঙ্গে অর্থের অভাবে সুচিকিৎসা করাতেও পারেন না।
ছোট ছোট সন্তানদের ভালো কিছু খাওয়াতে হিমশিম খান। স্বামীর সঙ্গেও শ্বশুর-শাশুড়ির অভাব-অনটনের সংসারে অনিশ্চিত ভবিষ্যত জীবন পার করতে হচ্ছে গৃহবধূ এ্যানীর। তিনি এ কথাগুলো জানাচ্ছিলেন যুগান্তর প্রতিনিধিকে।
গৃহবধূ এ্যানী রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের যদু ফকিরপাড়ার বাসিন্দা। এইচএসসি পাশ করার পর অর্থের অভাবে পড়ালেখা চালাতে না পারায় বাবা-মায়ের ইচ্ছায় ২০১৫ সালে তার বিয়ে হয়।
স্বামী মুক্তার ফকিরের সংসারে এসে মোকাবেলা করতে হয় অভাব ও অনটন। অভাবের সঙ্গে যোগ হয় স্বামীর হঠাৎ অসুস্থতা। অসুস্থ স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন এ্যানী। এভাবে বেশি দিন ঘরে বসে না থেকে কর্মের সন্ধানে ঘর থেকে বের হন তিনি। চলে যান গোয়ালন্দ উপজেলা মহিলা অধিদপ্তর কার্যালয়ে।
প্রথমে সেখান থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে বাড়িতে বসে কাজ শুরু করেন। পরিবারের অভাব কিছুটা নিরসন হলে তিনি তখনো দমে যাননি।
স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইউটিউিবে দেখতে পান মুড়ি ভাজা। মনোযোগসহকারে দেখে স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করেন। সেই সঙ্গে পরামর্শ করেন মহিলা অধিদপ্তরেও। মহিলা অধিদপ্তরের গোয়ালন্দ উপজেলা কর্মকর্তা সালমা বেগমের সহযোগিতা নিয়ে শুরু করেন মুড়ি ভাজার কার্যক্রম। সেই থেকে শুরু হয় তার পথচলা।
প্রথমে একটি মেশিন, একটি ঘর ও কিছু আমানত সংগ্রহ করেন, তারপর আত্মীয়স্বজন গ্রামের পাড়াপ্রতিবেশী, স্থানীয় একটি এনজিও থেকে টাকা সংগ্রহ করে শুরু করেন মুড়ি ভাজার কাজ। স্বামী এবং শ্বশুর-শাশুড়ি ও ননদ নিয়ে ধীরে ধীরে শুরু করেন ব্যবসা। তারপর সেটা বাজারজাত করতে থাকেন, মুড়ি বাজারজাত করার পর থেকে তাকে আর পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে হয়নি।
এ্যানী আক্তার বলেন, কর্মের মাধ্যমে আমি ঘুরে দাঁড়াতে চাই। লজ্জা করে ঘরে বসে থাকলে কেউ খাওয়ায়ে দিবে না, সংসারে আসবে না সচ্ছলতা। তাই অভাব-অনটন ও দারিদ্রতাকে দুর্বল না ভেবে বরং পুঁজি করে কাজ শুরু করেছি। প্রথমে এ কাজ করতে গিয়ে অনেক বাধা পেয়েছি। অনেককেই বলতে শুনেছি নারীরা ঘরে থাকবে। সে কেন ঘর থেকে বের হবে। আমি ঘরে বসে থাকিনি। মানুষের কথায় কান না দিয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণায় ঘর থেকে বের হয়েছি। এখন আমি সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত মুড়ি ভাজার কাজ করি।
গ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে নারী-পুরুষ আসেন আমার এ কাজ শিখতে। তারা নিজে এ কাজে প্রতিষ্ঠিত হতে চান। এখন আমি নিজের কর্মস্থান করে খুব আনন্দ পাই। আমার কাজের সঙ্গী স্বামী ও শাশুড়ি ও ননদ রয়েছে। সেই সঙ্গে রযেছে আরও দুইজন কর্মচারী। মোট ৭ জন মিলে কাজ করে থাকি।
সফল এই নারী উদ্যোক্তা এ্যানী বলেন, এই ভাজা মুড়িগুলো বেশ স্বাস্থ্যসম্মত। মাটির চুলায় এগুলো ভাজা হয়। তবে একটি মেশিন শুধু মোটরে ঘুরে, এতে চাল গরম করতে হয়। এরপর গ্রামীণ পদ্ধতিতে মাটির চুলায় সামান্য লবণ মিশিয়ে মুড়ি ভাজার কাজ করতে হয়। মুড়িতে কোনো প্রকার কেমিক্যাল মেশানো হয় না। হাতে ভাজা মুড়ির বাজারে অনেক চাহিদা আছে।
এ্যানী বলেন, এখন প্রতিদিন ৩ থেকে ৪শ কেজি মুড়ি ভাজতে পারি। স্বামীকে দিয়ে সেটার বাজারজাত করি। বড় পরিসরে করার ইচ্ছা আছে, তবে ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে টাকা নিতে পারলে সেটা করা সম্ভব হতো; কিন্ত যেখানে চাই সেখানেই কঠিন শর্ত জুড়ে টাকা দেওয়ার অফার করে। সুতরাং ব্যাংক লোন নিতে পারি না। তবে আমি হতাশ নই, আমি আশাবাদী।
এলাকার স্থানীয় একাধিক নারী-পুরুষ বলেন, মুক্তারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। বিয়ের কিছু দিন পর অসুস্থ হয়ে পড়েন; কিন্তু ওর স্ত্রী এ্যানী কারো সহযোগিতা না নিয়ে মুড়ি ভাজার কাজ শুরু করেন। এখন মুড়ি ভাজার কারখানা দিয়ে সে অনেকটা ভালো আছেন। ওর সাহসিকতা দেখে এখন অনেকে মুড়ি ভাজার কাজে এগিয়ে আসছেন। তবে প্রথমে আমরা এলাকাবাসী তাকে অনেক রকম কথা বলতাম।
দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান মন্ডল বলেন, আমার জানা ছিল না যে ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই একটি মুড়ি ভাজার কারখানা আছে। সংবাদকর্মীদের মাধ্যমে জানতে পারলাম।
তিনি আরও বলেন, আমি গর্বিত আমার ইউনিয়নের সাধারণ নারী-পুরুষ এখন ঘরে বসে নেই। বিভিন্ন কর্মের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছেন। তবে এক্ষেত্রে সহযোগিতা লাগলে গৃহবধূ এ্যানীকে অবশ্যই আমি সহযোগিতা করব।
এ বিষয়ে গোয়ালন্দ মহিলা অধিদপ্তর কার্যালয়ের কর্মকর্তা সালমা বেগম বলেন, এ্যানী মহিলা অধিদপ্তরের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমাদের পরামর্শও নিয়েছেন। তিনি এখন ছোট্ট পরিসরে একটি কারখানা তৈরি করেছেন। যেখানে পরিবারের সদস্যসহ ৫ জন কর্ম করছেন। এই নারী উদ্যোক্তা এ্যানীর সামনের দিকে আরও এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা কাজ করছি। আশা করি এ্যানীর মতো অনেকে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে বসে না থেকে উদ্যোক্তা হবেন। মহিলা অধিদপ্তর সবার পাশে সব সময় থাকবে।
এ বিষয় গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র যুগান্তরকে বলেন, আমি এই নারী উদ্যোক্তার কারখানা ঘুরে দেখেছি, সুন্দর পরিসরে এই নারী এগিয়ে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। ইতোমধ্যে সে জয়িতা হওয়ার গৌবর অর্জন করেছে।
তিনি আরও বলেন, নারীরা এখন আর ঘরে বসে থাকে না। সকল কর্মস্থানে নারীরা সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। তারা আপনগতিতে এগিয়ে যেতে চায়। আমাদের সবার উচিত নারী উদ্যোক্তাদের অসম্মান না করে বরং কাজের জন্য সার্বিক সহযোগিতা করা।