মো. আবদুর রহমান
খুশুখুজু বা বিনয়-একাগ্রতা হচ্ছে নামাজের প্রাণ। নামাজের যাবতীয় ফজিলত, প্রভাব ও উপকারিতা এই খুশুখুজুর সঙ্গেই সম্পৃক্ত। খুশুখুজুর সঙ্গে নামাজ আদায় করলে নামাজ প্রাণবন্ত হয়। আর খুশুখুজুহীন নামাজ প্রাণহীন লাশের মতো। তাই নামাজে খুশুখুজু অবলম্বন করা একজন মুমিন বান্দার জন্য আবশ্যক।
নামাজে খুশুখুজুর গুরুত্ব : ইসলামি শরিয়তে খুশুখুজুর গুরুত্ব অপরিসীম। খুশুখুজু বা একাগ্রতা নামাজের প্রাণ। খুশুখুজুহীন নামাজ প্রাণহীন ইবাদত। তাই ইবাদতের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদনের জন্য খুশুখুজু তথা একাগ্রতার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বর্তমানে এই ব্যস্ত যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে একাগ্রচিত্তে নামাজ আদায় করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ একাগ্রতাহীন নামাজ দায়সারা ও শারীরিক ব্যায়ামের উপকারিতা ব্যতীত তেমন কিছুই বয়ে আনে না। মহান আল্লাহর কাছে এমন নামাজের মূল্য নেই। এসব নামাজিদের মহান আল্লাহ নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন এবং শাস্তির অঙ্গীকার করেছেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘দুর্ভোগ সেসব নামাজির জন্য, যারা তাদের নামাজের ব্যাপারে উদাসীন।’ (সুরা মাউন ৪-৫)
একাগ্রতায় কপটতা : একজন মানুষ যখন তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে একাগ্রতা ধারণ করে অথচ তার অন্তর একাগ্রতা থেকে খালি থাকে, তখন সে নেফাকি খুশুর শিকারে পরিণত হয় অর্থাৎ অন্তরের একাগ্রতায় কপটতা চলে আসে। যা খুবই নিন্দনীয়। অন্তরের একাগ্রতায় যেন কপটতা চলে না আসে সে জন্য সাহাবায়ে কেরাম এবং তাদের উত্তরসূরিরা এ ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন থাকতেন। হজরত হুজায়ফা (রা.) বলতেন, ‘তোমরা নেফাকি খুশু থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও।’ তার কাছে জিজ্ঞেস করা হলো, নেফাকি খুশু কী? উত্তরে তিনি বললেন, ‘এটি হচ্ছে নামাজে বাহির থেকে দেখতে তোমাকে খুব বিনয়ী ও মনোযোগী মনে হবে; কিন্তু তোমার অন্তরের অবস্থা থাকবে সম্পূর্ণ উল্টো।’
হজরত আবু দারদা (রা.) থেকেও এমন একটি হাদিস বর্ণিত আছে, খুশুখুজুর ক্ষেত্রে নেফাক হলো এই যে, ‘বাহ্যিকভাবে দেহ শান্ত ও নম্র থাকে এবং বোঝা যায় খুশুখুজু আছে। কিন্তু বাস্তবে তার অন্তরে খুশুখুজু নেই।’ হজরত কাতাদাহ (রা.) বলেন, ‘অন্তরের খুশুখুজু হলো আল্লাহর ভয় অন্তরে জাগ্রত করা এবং নামাজের সময় দৃষ্টিকে অবনত রাখা।’ (দুররুল মানসুর ৬/৮৪)
ফুজায়েল ইবনে আয়াদ (রহ.) বলেন, ‘অতীতকালে অন্তরে বিদ্যমান একাগ্রতার চেয়ে বেশি খুশু প্রদর্শন করা ঘৃণার চোখে দেখা হতো।’ হজরত ওমর (রা.) একবার এক ব্যক্তিকে দেখলেন, সে মাথা খুব নিচু করে নামাজ আদায় করছে। তিনি বললেন, ‘হে মাথানতকারী! মাথা ওঠাও। অন্তরে যে পরিমাণ খুশুখুজু আছে তারচেযে বেশি প্রকাশ করো না।’ সুতরাং যে ব্যক্তি অন্তরের একাগ্রতার চেয়ে বেশি একাগ্রতা প্রকাশ করবে সেই নেফাকি খুশুখুজু তথা একাগ্রতার ক্ষেত্রে কপটতায় লিপ্ত হলো। প্রকৃত খুশু এবং নেফাকি খুশুর মধ্যে কিছু পার্থক্য তুলে ধরা হলো।
নেফাকি খুশু : এক. হৃদয় কামনা-বাসনা দ্বারা ভরপুর থাকে। দুই. শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিনয়ী হলেও হৃদয়ে আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা থাকে না মোটেও। তিন. এ ধরনের খুশু রিয়া বা লোক দেখানো আমলের পর্যায়ভুক্ত। কারণ এই খুশু লোক দেখানোর জন্য, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য নয়।
প্রকৃত খুশু : এক. হৃদয়ে কোনো কামনা-বাসনা থাকে না। দুই. আল্লাহর সামনে দাঁড়ালে নিজের ভুল-ভ্রান্তির কারণে হৃদয় লজ্জিত হয়। সম্পূর্ণ সত্তা আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়। তিন. লজ্জা ও ভালোবাসায় হৃদয় আল্লাহতে লীন হয়ে যায়। ফলে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও অন্তরের খুশুর বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
নামাজে খুশু সৃষ্টিতে সহায়ক বিষয় : শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, দুটি জিনিস নামাজে খুশু সৃষ্টিতে সহায়তা করে। এক. ফরজ পালনের প্রবল আগ্রহ। দুই. মনোযোগ নষ্টকারী বিষয়গুলো পরিহার করা। এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
ফরজ পালনের প্রবল আগ্রহ : এর উদ্দেশ্য হলো, নামাজি ব্যক্তি নামাজে যা বলছে এবং করছে তাতে মনোযোগ নিবদ্ধ করতে কঠোরভাবে চেষ্টা করা। নামাজে কোরআন তেলাওয়াত, জিকির ও দোয়া করার সময় এর অর্থ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। আর নামাজরত অবস্থায় আমি আল্লাহর সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছি যেন আমি আল্লাহকে দেখছি, এ কথা মনে রাখা।
জিবরাইল (আ.) হজরত রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, ইহসান কাকে বলে? তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, যেন তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছ। আর যদি তুমি তাকে দেখতে না পাও, তবে (বিশ্বাস রাখবে) তিনি অবশ্যই তোমাকে দেখতে পাচ্ছেন।’ (সহিহ বুখারি) একজন বান্দা যত বেশি নামাজের মধুময় স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে, সে নামাজে ততই আসক্ত হবে। আর এটি ইমানের মজবুতির সঙ্গে সম্পর্কিত।
মনোযোগ নষ্টকারী বিষয় পরিহার করা : এর মানে হলো, যা কিছু আমাদের মনোযোগ নষ্ট করে তা দূরে সরিয়ে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করা। আর নামাজে খুশু তথা একাগ্রতা বিনষ্টকারী বিষয় ও চিন্তাসমূহকে মন থেকে মুছে ফেলা। এ ব্যাপারে নামাজিদের মধ্যে ভিন্নতা আছে। কারণ একজন ব্যক্তির সন্দেহ, বাসনা, হৃদয়ের অবস্থা এবং অন্তর যা পছন্দ করে তার ওপর নির্ভরশীলতা, আর অন্তর যা অপছন্দ করে তা এড়ানোর প্রচেষ্টা, এসবের মাত্রা তার ভেতরে শয়তানের ওয়াসওয়াসার সঙ্গে সম্পর্কিত।
নামাজে খুশুখুজু অর্জনের উপায় : এক. উত্তমরূপে অজু সম্পন্ন করা। দুই. আজান শোনার সঙ্গে সঙ্গে মানসিকভাবে অন্তরকে নামাজের দিকে মনোযোগী করা। তিন. সুন্দর ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করা। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে আদম সন্তান, প্রত্যেক নামাজের সময় তোমরা সুন্দর পোশাক পরিধান করো।’ (সুরা আরাফ ৩১) চার. নিরিবিলি পরিবেশে ইখলাস ও ইহসানের সঙ্গে নামাজ আদায় করা। পাঁচ. নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি পন্থা পরিহার করা। ছয়. সব নামাজ এমনভাবে মনোযোগের সঙ্গে পড়া উচিত, যেন এ নামাজই জীবনের শেষ নামাজ। সাত. নামাজে এমনভাবে আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে, যেন সামান্য মুহূর্তের জন্যও আল্লাহতায়ালার সত্তা হতে মন ছুটে, অন্যদিকে চলে না যায়। আট. নামাজির মনে বিনয় ও আল্লাহভীতি জাগ্রত রাখা। নয়. তেলাওয়াতের দিকে গভীর মনোযোগী হওয়া। দশ. নামাজে পঠিত কোরআনের আয়াত, তাসবিহ, দোয়া ও জিকিরসমূহের অর্থ ও মর্ম অনুধাবনের চেষ্টা করা। এগারো. স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে কোরআন তেলাওয়াত করা। রাসুল (সা.) প্রতিটি সুরা ধীরস্থিরভাবে পড়তেন। বারো. রুকু ও সেজদার তসবিহ্গুলো ধীরস্থিরভাবে পড়া। তেরো. নামাজের রুকনগুলো (রুকু, সিজদা, কিয়াম) শান্ত ও ধীরস্থিরভাবে আদায় করা। নামাজে রাসুল (সা.) অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে রুকনগুলো আদায় করতেন, যাতে প্রত্যেকটি অঙ্গ তার যথাযথ স্থানে অবস্থান করে। চৌদ্দ. নামাজ আদায়ের সময়ে একেবারে প্রয়োজন ব্যতীত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নড়াচড়া না করা। পনেরো. নামাজের মধ্যে ডানে-বামে বা এদিক-ওদিক না তাকানো। ষোলো. নামাজে দাঁড়ানো অবস্থায় সেজদার জায়গায় দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা। সতেরো. নামাজিকে তার সামনে দিয়ে গমনকারীদের অসুবিধা থেকে বাঁচার জন্য সামনে কোনো বস্তু রাখা। এই বস্তুকে ‘সুতরা’ বলা হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন খালি স্থানে নামাজ পড়তে দাঁড়াবে, তখন সামনে সুতরা নিয়ে নেবে এবং সেটার নিকটবর্তী হয়ে দাঁড়াবে।’ (আবু দাউদ) আঠারো. ভাবতে হবে আল্লাহতায়ালা নামাজে আমাদের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন। উনিশ. নামাজে বেশি বেশি মৃত্যুর কথা স্মরণ করা। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তুমি নামাজে মৃত্যুর কথা স্মরণ করো। কারণ মানুষ যখন তার নামাজে মৃত্যুর কথা স্মরণ করবে, তখন তার নামাজ অবশ্যই সুন্দর হবে। আর তুমি সেই ব্যক্তির মতো নামাজ পড়, যে মনে করে, এটাই তার জীবনের শেষ নামাজ।’ বিশ. বেশি বেশি গোপন ইবাদতে মগ্ন হওয়া। একুশ. সকল গুনাহ থেকে তওবা করা এবং গুনাহ পরিহার করা। বাইশ. হারাম খাদ্য এবং হারাম পোশাক-পরিচ্ছদ পরিহার করা। তেইশ. বেদয়াতমুক্ত আমল করা। চব্বিশ. আল্লাহর কাছে খুশুখুজুর জন্য সাহায্য চাওয়া। পঁচিশ. কোরআন ও হাদিসের আলোকে জীবনযাপন করা। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে পরিপূর্ণ খুশুখুজুর সঙ্গে নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।