April 29, 2024, 4:03 pm
ব্রেকিং নিউজ

পর্যটন শিল্প : অর্থনীতিতে রাখতে পারে বিরাট ভূমিকা

রিপোর্টারের নাম:
  • আপডেট টাইম Monday, September 25, 2023
  • 114 দেখা হয়েছে

সালেক উদ্দিন
প্রকৃতির বিস্ময় সৃষ্টি অবলোকন ও উপভোগের মধ্য দিয়ে আনন্দঘন সময় কাটানো মানুষের সহজাত ধর্ম। পর্যটন এসবের সহজলভ্যতার উল্লেখযোগ্য মাধ্যম। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা বিভিন্ন দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক অবকাঠামো ও আনন্দ উপভোগের জন্য বিশ্বময় ছুটে বেড়ায়।

এদেশে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের রয়েছে জীববৈচিত্র্যে ভরপুর পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন ‘সুন্দরবন’, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ ইত্যাদি। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতগুলোর একটি আমাদের কক্সবাজার। এছাড়াও রয়েছে সেন্টমার্টিন, রাঙ্গামাটি, কাপ্তাই হ্রদ-বান্দরবান লামাসহ পার্বত্য জেলাগুলোর বৈচিত্র্যময়তা। ইউনেস্কো সম্মানে ভূষিত ষাট গম্বুজ মসজিদ, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার কুয়াকাটা পর্যটনকেন্দ্র, তারুয়া সমুদ্রসৈকত, ঐতিহাসিক লালবাগের কেল্লা, আহসান মঞ্জিল ইত্যাদি হাজারও অবকাঠামো আমাদের ঐতিহ্য।

একটি দেশে অর্থনীতির জন্য ভ্রমণ ও পর্যটন শিল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে দেশের পর্যটন শিল্প, যোগাযোগব্যবস্থা, জননিরাপত্তা যত ভালো, সে দেশে বিদেশি পর্যটকদের আগমন-বিচরণ ও অবস্থান তত বেশি এবং স্বাভাবিকভাবেই সেই দেশের অর্থনীতি সুদৃঢ় অবস্থান লাভ করে। সৃষ্টি হয় ব্যাপক কর্মসংস্থানের। কোনো কোনো দেশে অর্থনীতির সিংহভাগ অর্জনই হয় পর্যটন শিল্প থেকে। এশিয়ার মধ্যেই পর্যটনের টানে যেসব দেশে আমি বহুবার গিয়েছি, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি। পর্যটন শিল্পের কারণে এসব দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার যথেষ্ট ভারী এবং এদের মধ্যে কোনো কোনো দেশ উন্নত দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

সিঙ্গাপুরের কথাই ধরি। বিশ্বের উন্নত দেশ হিসাবে পরিচিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি ছোট্ট দ্বীপ সিঙ্গাপুর। এর আয়তন ৬৯৯ বর্গকিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা মাত্র ৫০ লাখ। দেশটি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের পাশাপাশি কৃত্রিমভাবে যা যা তৈরি করা প্রয়োজন, তাই তৈরি করেছে। এখানে রয়েছে নাইট সাফারি, মারলওন পার্ক, সেন্ট্রোসা আইল্যান্ড, বার্ড পার্ক ইত্যাদি। এছাড়াও পর্যটকদের বিনোদনের জন্য ক্যাসিনোসহ নানা ধরনের নানা উপভোগ্য উপকরণের পর্যটন কালচার সৃষ্টি করেছে তারা। আইনশৃঙ্খলার বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় যেন না হয়, তা তারা নিশ্চিত করেছে। যোগাযোগব্যবস্থা, বসবাস ব্যবস্থা, জননিরাপত্তা ইত্যাদি শতভাগ নিশ্চিত করেছে; যার কারণেই হবে হয়তো সারা বিশ্বের পর্যটকরা জীবনে একবারের জন্য হলেও এ ছোট্ট দেশ সিঙ্গাপুরে আসার বাসনা রাখে। প্রায় সারা বছরই সিঙ্গাপুর পর্যটকে ভরপুর থাকে। মাঝেমধ্যে তাদের নিজস্ব জনসংখ্যার চেয়ে পর্যটকের সংখ্যা বেশি থাকে।

আমাদের দেশে পর্যটকদের নিরাপত্তার বালাই নেই। যেমন কক্সবাজারের মতো দেশের সেরা পর্যটন কেন্দ্রে সস্ত্রীক বেড়াতে গিয়ে প্রভাবশালী দুর্বৃত্তদের হাতে স্বামী নির্যাতিত হয় এবং স্ত্রী শিকার হয় গণধর্ষণের। এটি একটি বিছিন্ন ঘটনা হলে আলোচনায় আনতাম না। ঘটনা ঘটিয়ে পার পাওয়া যায় বলেই আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনার অভাব নেই। এটি কি পর্যটনবান্ধব পরিবেশ? সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের পর্যটক দেশগুলোতে এটি কল্পনাও করা যায় না। এ রকম ঘটনা সেখানে ঘটলে তাদের পর্যটন ব্যবসার দশা আমাদের মতোই হতো। এ ব্যাপারে তারা অতিসচেতন বলেই তাদের পর্যটন ব্যবসার অবস্থান আকাশচুম্বী। তাদের অবস্থায় যেতে হলে আমাদের দেশেও আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা, যোগাযোগব্যবস্থা, বসবাসব্যবস্থা, জননিরাপত্তা ইত্যাদি শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে।

এবার আসি মালয়েশিয়ার কথায়। আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার হিসাবে যার নাম বলা হয়, তিনি হলেন ডা. মাহাথির মোহাম্মদ। তিনি প্রথমেই যা করেছিলেন, তাহলো দেশের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি এবং জননিরাপত্তা। হ্যাভেন অব এশিয়া হিসাবে পরিচিত মালয়েশিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অভাব নেই। এত কিছুর মধ্যে যদি পর্যটকরা তাদের চাহিদার সহজলভ্যতা পায়, নিরাপত্তার বিষয়টি শতভাগ নিশ্চয়তা পায়, তবে বিশ্বের পর্যটকরা সে দেশ ভ্রমণে উদগ্রীব হয়ে পড়বেন সেটাই স্বাভাবিক। আয়তনে বাংলাদেশের দ্বিগুণেরও বড় এ দেশটি জনসংখ্যা মাত্র তিন কোটি। মুসলিম দেশ হলেও এখানে রয়েছে মাল্টি কালচার। বিদেশি পর্যটকদের চাহিদার কোনো কিছুতেই তারা তো বাধা দেয়ই না, বরং পর্যটন এলাকাগুলো ভ্রমণ ও আনন্দ উপভোগের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করে। এ দেশে পর্যটকদের জন্য তারা তৈরি করেছে গ্যান্টিন হাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন মনোমুগ্ধকর ব্যবস্থা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে ক্যাসিনো, নাইট ক্লাবসহ পর্যটকদের মনোরঞ্জনের সব উপকরণই রয়েছে এসব পর্যটন এলাকায়। যার কারণেই হবে হয়তো পর্যটকদের ভিড়ে সব সময় জমজমাট হয়ে থাকে মালয়েশিয়ার পর্যটন কেন্দ্রগুলো। ফলে এ বিশাল দেশটির জনসংখ্যা মাত্র তিন কোটি হলেও প্রায় সারা বছরই বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা তাদের জনসংখ্যার সমান সমান থাকে বরং কখনো কখনো আরও বেশি হয়।

প্রতিবেশী ভারতের পর্যটন শিল্পের কথা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। পর্যটকদের ধারণা শুধু ভারত ভ্রমণ করে একজন পর্যটক যে সৌন্দর্য অবলোকন ও আনন্দ উপভোগ করতে পারে, তাতে তাদের পৃথিবীর চার ভাগের এক ভাগ দর্শনের অভিজ্ঞতা হয়ে যায়। স্বাভাবিক কারণেই পর্যটন শিল্প ভারতের অর্থনীতিতে এক বিরাট ভূমিকা রাখে। নেপাল, থাইল্যান্ডের কথা যদি বলি, একই কথার পুনরাবৃত্তিই করতে হবে।

মোদ্দা কথা, সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই পর্যটকরা চোখের ক্ষুধা, মনের ক্ষুধা মেটানোর জন্যই দেশ-বিদেশ ঘুরছে। তারা যে দেশে যত বেশি যায়, সে দেশের অর্থনীতি তত চাঙা থাকে। বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার তত সমৃদ্ধ হয়।

আমাদের দেশের পর্যটন শিল্পের যে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে এবং যা আমাদের অর্থনীতিকে চাঙা করতে পারে এবং বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডার সমৃদ্ধিশালী করতে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মালয়েশিয়ার গ্যানটিন হাইল্যান্ড যা প্রতিদিন শতশত বিদেশি পর্যটকদের বিচরণে সরগম হয়ে থাকে; আমাদের বান্দরবানের চৌম্বক পাহাড়ে সেরকম আয়োজন করা সম্ভব।

দেশের যাতায়াত ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে। পর্যটন ব্যবসার জন্য পরিকল্পিতভাবে আরও উন্নয়ন প্রয়োজন। প্রয়োজন দেশ-বিদেশের পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তাব্যব্যস্থা ও পর্যটন কেন্দ্রগুলো আকর্ষণীয়ভাবে সাজানো। সবমিলিয়ে উন্নত পর্যটন ব্যবস্থাপনার। আর তা করতে পারলেই কক্সবাজার, কুয়াকাটাকে নামকাওয়াস্তে সমুদ্রসৈকত মনে হবে না। উন্নত বিশ্বের চোখ ধাঁধানো সমুদ্রসৈকতের চেয়েও আমাদের সমুদ্রসৈকত দিয়ে পর্যটকদের আরও বেশি আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে।

একইভাবে এক্সক্লুসিভ পর্যটন জোন নিশ্চিতের মাধমে তিন পার্বত্য জেলা, মহেশখালী, নিঝুম দ্বীপ, মহাস্থানগড়, রাঙ্গামাটি, হাতিয়া, সোনাদিয়া, ময়নামতী, রামসাগর, সিলেটের চা বাগান, জাফলং, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত ইত্যাদি দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে যথার্থ স্থান হয়ে উঠতে পারে। এসব স্থান পর্যটকদের অবকাশ যাপনের আকর্ষণীয় স্থান হয়ে উঠতে পারে।

সিঙ্গাপুরের অর্থনীতির প্রাণভোমরা যে পর্যটন শিল্প, সেই রকম একটি সিঙ্গাপুর আমাদের কক্সবাজার এবং পার্বত্য জেলায় তৈরি করা অসম্ভব নয়। বরং তারচেয়েও ভালো কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব। কারণ, সিঙ্গাপুরের পর্যটন কেন্দ্রগুলোর অধিকাংশই কৃত্রিম আর আমাদেরটা হবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে কৃত্রিমতার মিশ্রণে অনন্য পর্যটনভূমি। পর্যটন শুধু শিল্প নয়, এটি সংগত কারণেই দেশের উল্লেখযোগ্য লাভজনক পর্যটন ব্যবসায় রূপান্তরিত হয়।

পর্যটন ব্যবস্থাপনা সফল দেশগুলোর মতো আমরাও পর্যটন শিল্পের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে দেশের অর্থনীতিতে, বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডারে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারি। এর জন্য প্রয়োজন রয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করা, প্রয়োজন রয়েছে উন্নত পর্যটন দেশগুলোর মতো যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন করা, গোঁড়ামির বলয় থেকে বেরিয়ে আসা, পর্যটকদের জন্য আনন্দময় উপভোগ্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করা, জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা, প্রচার-প্রসারের ব্যবস্থা করা, পর্যটন টিভি চ্যানেল প্রবর্তন করা, পর্যটন এলাকায় পর্যটন কালচার তৈরি করা।

আমাদের দেশের জন্য এটি একটি বিপ্লবই বলতে হবে। আর এ বিপ্লব সাধিত হলে আমরা যে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, তা বাস্তবায়নে পর্যটন একটি অনেক বড় ভূমিকা রাখবে। এর জন্য প্রয়োজন রয়েছে পর্যটন শিল্পে সফল দেশগুলো বিশেষ করে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার সফলতার কারণগুলো খুঁজে বের করে বাংলাদেশের পর্যটনের ক্ষেত্রে সেসবের সঠিক প্রয়োগ করা।

কাজটি কঠিন হলেও আমাদের পক্ষে সম্ভব। কারণ, আমরা অনেক অসম্ভবকে সম্ভব হতে দেখেছি। যে জাতি চ্যালেঞ্জ নিতে অভ্যস্ত, তাদের জন্য পর্যটন বিপ্লব কঠিন কাজ নয়। শুধু প্রয়োজন সুন্দর একটি স্বপ্ন এবং তা বাস্তবায়নে একাগ্রচিত্তে নিরলস প্রচেষ্টা।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘমেয়াদি ‘পর্যটন মহাপরিকল্পনা’হাতে নিয়েছে বলে অবহিত হয়েছি। এর কার্যক্রম শুধু ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবসের রমরমা আয়োজনের ফ্রেমেই আটকে না থাকুক-সেটাই প্রত্যাশা।

 

সালেক উদ্দিন : পর্যটন বিশেষজ্ঞ

শেয়ার করুন
এই ধরনের আরও খবর...
themesba-lates1749691102