অনলাইন ডেস্ক:
ডেসটিনি-২০০০, ইউনি পে টু ইউ-এর মতো প্রতারক এমএলএম কোম্পানির তালিকায় নাম লেখাল এমটিএফই নামের আরেক প্রতিষ্ঠান। অনলাইন ট্রেডিংয়ের নামে বাংলাদেশিদের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে টাকা তোলার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে তারা।
ফলে অধিকাংশ বাংলাদেশির ওয়ালেটের ব্যালেন্সে ডলার থাকলেও সেই ডলার তারা তুলতে পারছেন না। শুক্রবার ও শনিবার অনেকের এমটিএফই ওয়ালেটের ব্যালেন্স ঋণাত্মক বা মাইনাস দেখানো হচ্ছে। অর্থনীতির ভাষায় প্রতিষ্ঠান লোকসান করায় গ্রাহকদের কাছ থেকে তারাই বরং টাকা পাবে বলে দাবি করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে এমটিএফই-এর কত গ্রাহক আছে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেনি। তবে এমটিএফই-এর হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে মোট ৮ লাখ অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে তাদের অ্যাপে। শুধু বাংলাদেশ নয় দুবাই, ওমান, কাতার সৌদি আরবের মতো দেশগুলোতে কর্মরত বাংলাদেশিরাও এমটিএফইতে বিপুল পরিমাণে অর্থ বিনিয়োগ করেছে। তবে বাংলাদেশে এদের কোনো অফিস নেই।
এমটিএফই কি?
এমটিএফই হচ্ছে মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ নামে একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি (যেমন- বিট কয়েন) ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম। এখানে বিনিয়োগকারীদের উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলানো হয়। ক্রিপ্টো ট্রেডিং বাংলাদেশে নিষিদ্ধ।
এমটিএফইতে ক্রিপ্টো ট্রেডিং করে মুনাফা লাভের পাশাপাশি আরেকটি প্রলোভন দেখানো হয়। একজন গ্রাহক যদি নতুন কাউকে এখানে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেন, তাহলে তিনি নতুন গ্রাহকের বিনিয়োগ থেকেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে অতিরিক্ত আয় করতে পারবেন। ডেসটিনির মতো এটিও একটি এমএলএম কোম্পানি।
অনলাইন প্ল্যাটফর্মে থাকলেও এমটিএফই নিজেদের কানাডিয়ান কোম্পানি দাবি করে, যার প্রতিষ্ঠাকাল ২০০৫ সালে। তবে বাংলাদেশে এ বছরের জানুয়ারি মাসে তাদের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়েছে। এমটিএফই-এর বিরুদ্ধে কানাডিয়ান সিকিউরিটিজ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরস (সিএসএ)-এর কাছে প্রতারণার বেশ কয়েকটি অভিযোগও রয়েছে।
কিভাবে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে এমটিএফই?
একজন নাগরিক এমটিএফই এবং বাইনান্স নামের একটি অ্যাপ ডাউনলোড করে খুব সহজেই এমটিএফইতে রেজিস্ট্রেশন করতে পারতেন। রেজিস্ট্রেশনের পর তাদের নিজস্ব ওয়ালেটে ট্রেডের জন্য ডলার রাখতে হতো। ডলারের পরিমাণ অনুযায়ী তাদের প্রতিনিয়ত লাভ দেওয়ার প্রলোভনও দেওয়া হতো।
বিজ্ঞাপনে এমটিএফই বলতো, কেউ যদি ২৬ থেকে ৬০ ডলার বিনিয়োগ করেন, সেক্ষেত্রে তিনি প্রতিদিন ০.৩৯ ডলার থেকে ০.৬০ মার্কিন ডলার লাভ করতে পারবেন। একইভাবে ৬১ থেকে ২০০ ডলার বিনিয়োগে প্রতিদিন ০.৯৮ ডলার থেকে ২.০৫ ডলারের লাভ, ২০১ থেকে ৫০০ ডলার বিনিয়োগে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫.০৯ ডলার পর্যন্ত লাভ, ৫০১ থেকে ৯০০ ডলার বিনিয়োগে প্রতিদিন ১০.৯৩ থেকে ১৪.৬৪ ডলার পর্যন্ত লাভ, ৯০১ থেকে ১৫০০ ডলার বিনিয়োগে ১৮-২৪.৪০ ডলার পর্যন্ত লাভ, ৩৫০১ থেকে ৫০০০ ডলার বিনিয়োগে ৮৫ থেকে ১২৫ ডলার পর্যন্ত এবং ৫০০১ ডলার থেকে ১০ হাজার পর্যন্ত বিনিয়োগে প্রতিদিন ১১০ থেকে ১৬০ ডলার পর্যন্ত লাভ হতে পারে বলে লোভ দেখানো হয়।
কেউ যদি ডেসটিনির মতো তার বন্ধু বা পরিচিতদের বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেন, তার লাভ আরও বাড়িয়ে দেয় এমটিএফই। তবে ওয়ালেটে লাভের টাকা থাকলেও নানা শর্তের কারণে সবসময় টাকা উত্তোলন করা যায় না, ইচ্ছেমতো অংকের টাকাও তোলা যায় না।
এমটিএফই-এর ফাঁদে পা দিয়ে দেশের প্রায় ৮ লাখ মানুষ হাজার হাজার কোটি টাকা হারিয়েছেন। কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে বর্তমানে তারা ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপে তাদের সর্বস্ব হারানোর গল্প লিখছেন।
সবকিছুর মূলে শুয়ে-বসে আয় করার ‘লোভ’
ডেসটিনি-২০০০, ইউনি পে টু ইউর পর এবার এমটিএফই। এ ধরনের প্রতারণা দেশে এর আগেও বহুবার ঘটেছে, তারপরও কেন মানুষজন এসব প্রতারকদের ফাঁদে পা দিচ্ছেন প্রশ্ন করা হলে তানভীর জোহা বলেন, এখানে একটি বিষয় হচ্ছে- যারা এ ধরনের প্রতারণায় ফাঁদে পা দিচ্ছেন, তারা মূলত লোভী। ইভ্যালি থেকে শুরু করে ই-অরেঞ্জ ও আলিশা মার্টের প্রতারণাও আমরা দেখেছি। আমাদের ডিজিটালাইজেশন তৃণমূল পর্যায়ে চলে গেছে। এর ফলে প্রযুক্তি জ্ঞান খুবই কম কিংবা এসব বিষয়ে একেবারেই ধারণা নেই। এ ধরনের মানুষজনের হাতেও মোবাইল ফোন চলে গেছে। তারা অনলাইন জুয়া থেকে শুরু করে অনেক বিষয়ে এখন সম্পৃক্ত। আইনের সুস্পষ্টভাবে বলা আছে- মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে দেশের বাইরে লেনদেন সম্পূর্ণ অবৈধ। এ ধরনের অ্যাপ্লিকেশন মোবাইল ফোনে পাওয়া গেলে কিন্তু অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে। বিএফআইইউতে প্রফেশনাল সফটওয়্যার থাকলে কিন্তু এ ধরনের অ্যাপ্লিকেশন অবশ্যই ডিটেক্ট হত। আর এখন যেসব সফটওয়্যার আছে, সেগুলো হয়তো সেইভাবে কনফিগার না। সেজন্যই এ ধরনের বিষয়গুলো ধরা পড়ছে না। তবে এ বিষয়ে যাদের মনিটরিং করার কথা ছিল, তাদের গাফিলতি রয়েছে বলেও এ প্রযুক্তিবিদ মনে করেন।
এমটিএফই-এর কার্যক্রম ও মোটা অংকের টাকা পাচারের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন। পোস্টে তিনি লিখেছেন, যার কোনো অফিস নেই, অস্তিত্ব নেই, স্বচ্ছতা বা অ্যাকাউন্টিবিলিটি নেই, সরকারের কোনো স্বীকৃতি নেই, কোনো রেজিস্ট্রেশন নেই, শুধু একটা অ্যাপের ভিত্তি করে এত আর্থিক সংকটের পরেও এ দেশের প্রায় ৪২ লাখ মানুষ ১ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা লোপাট করার সুযোগ করে দিলো!
রাতারাতি ‘সিইও’, রাতারাতি কাঁচা টাকা পাওয়ার লোভকে কত সহজে কাজে লাগিয়েছে এমটিএফই নামের এক প্রতিষ্ঠান! ১ বিলিয়ন ডলার! আর আমরা কিছুই টের পেলাম না! আর একদিন অন্য কেউ, অন্যরূপ নিয়ে আসবে। আবার জাল পাতবে। আবার হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাবে। এরপর মাথা চাপড়াবেন হতভাগারা। আমরা কেউ টের পাব না। পরে শুরু হবে তদন্ত। কত সহজ এ মাটি থেকে টাকা লোপাট করা! সোনার খনি এ মাটি।