April 25, 2024, 5:07 am
ব্রেকিং নিউজ

শিক্ষার্থী সংকটে প্রাথমিক বিদ্যালয়

রিপোর্টারের নাম:
  • আপডেট টাইম Monday, December 26, 2022
  • 62 দেখা হয়েছে

মো. সিদ্দিকুর রহমান
কওমি মাদ্রাসা ব্যতিরেকে প্রাথমিক, উচ্চবিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেনসহ প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করোনা-পরবর্তীতে শিক্ষার্থী ভর্তি হ্রাস পেয়েছে। করোনা মহামারি সময়ে কেবল কওমি মাদ্রাসা খোলা থাকার ফলে শিক্ষার্থীর ভর্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও তার সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৃণমূলের কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের সন্তানদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতকরণে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেছেন। বর্তমানে শিক্ষাবান্ধব সরকার বিনামূল্যে নতুন বই দেওয়া, বিদ্যালয় ভবন সুসজ্জিতকরণসহ অসংখ্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার ফলে অনেকটা শিশুর স্বর্গের উপযোগী করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক উচ্চশিক্ষিত মাস্টার্স, অনার্সসহ শিশুশিক্ষায় ট্রেনিংপ্রাপ্ত। এতদসত্ত্বেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভর্তি সংকট পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে কতিপয় চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করছি-

শিক্ষক সংকট : করোনা মহামারির শুরু হওয়ার আগে ২০২০ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী শিক্ষক ৩২ হাজার ৫৭৭টি শূন্য পদের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। প্রাথমিকের শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেওয়ায় প্রায় ৩ বছরে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে সময়ক্ষেপণ হতে যাচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা নিয়োগ ইতঃপূর্বেও ২/৩/৪ বছর সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। বর্তমানে সহকারী শিক্ষকের শূন্য পদের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। প্রাথমিক নিয়োগ প্রক্রিয়া এ সীমাহীন সময়ক্ষেপণ আগামী প্রজন্মের যে পাঠদানের বিশাল ক্ষতি হচ্ছে, তা সচিব, মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের উপলব্ধি হচ্ছে বলে দৃশ্যমান নয়। সহকারী শিক্ষক পদে প্রত্যাশীদের আন্দোলনের গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব শূন্য পদ পূরণে নির্দেশনা দিয়েছেন।

অপরদিকে প্রধান শিক্ষকের শূন্যপদের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। এত শূন্যের মাঝে প্রাথমিক বিদ্যালয় কীভাবে চলছে এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা অবতারণা করছি-পাকিস্তান আমলে এক বিদেশি নাস্তিক ভদ্রলোক পূর্ব পাকিস্তানে তথা আজকের বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি সারা দেশে ভ্রমণ করে স্রষ্টার সৃষ্টি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হন। পাশাপাশি আমাদের দেশের মানুষ সে সময় দূষিত পানি পান করতে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, এত ময়লা, দূষিত পানি খেয়ে তারা কীভাবে বেঁচে আছেন? সর্বশেষ তিনি সৃষ্টিকর্তার কৃপায় তারা বেঁচে আছেন-এ উপলব্ধি বোধ তার মাঝে জাগ্রত হলো। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদতবরণের পর থেকে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষক সংকট চলে আসছে। ২/৩/৪ বছর একবার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার পর অবসর, মৃত্যু, শিক্ষকতা পেশা ত্যাগসহ নানা কারণে ‘নদীর একূল ভাঙে, ওকূল গড়ে’ মতো দীর্ঘ সময়ক্ষেপণের পর শিক্ষক নিয়োগ এই তো তাদের খেলা। অপবাদের মাঝে ০১/২ জন শিক্ষক দিয়ে সৃষ্টিকর্তা দয়ায় চলে আসছে প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক মন্ত্রণালয় তথা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অবহেলায় এ শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া যুগ যুগ ধরে এভাবে চলে আসছে। অথচ মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে অভিভাবকমহল পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় তথা শিক্ষকদের ঠিকমতো পড়াশোনা করান না, এ অপবাদ থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না। শিক্ষক সংকটের কারণে দরিদ্র অভিভাবকরা উপবৃত্তিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা উপেক্ষা করে তাদের সন্তানদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে আগ্রহী হচ্ছে না। প্রবাদ আছে ‘পাগলেও তাদের বুঝ বোঝে’ দরিদ্র হলেও ডিজিটাল যুগে অভিভাবকরা তাদের সন্তানের প্রতি সচেতন। এর ফলে শিশু শিক্ষায় কিন্ডারগার্টেনসহ বেসরকারি বিদ্যালয়ের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

ভর্তি প্রক্রিয়া : শিশুশিক্ষায় সমৃদ্ধ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঝে বিদ্যমান। অথচ ভর্তি প্রক্রিয়া অবহেলিত বঙ্গবন্ধু ও তারই সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বপ্নের জাতীয়করণ ব্যাহত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। প্রতিবছরের মতো এবারও সরকারি-বেসরকারি উচ্চবিদ্যালয় ১৬ নভেম্বর থেকে তাদের ১ম শ্রেণিসহ ভর্তির কার্যক্রম শুরু করেছেন। অথচ নির্বাক হয়ে বসে আছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা। কিন্ডারগার্টেনসহ সব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভর্তি যখন সমাপ্ত হবে, তখন জানুয়ারি মাসে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী খুঁজে বেড়াবে। তখন তৃণমূলের কর্মকর্তারাসহ সবাই শিক্ষার্থী তেমন ভর্তি না হওয়ার অভিযোগ শিক্ষকদের দিকে আঙুল প্রদর্শন করতে করুণা করবে না। বদলি আতঙ্কে তাদের মাথার ওপর ঝুলছে। বর্তমানে এত উচ্চশিক্ষিত প্রাথমিক শিক্ষক। এ শিক্ষার্থী সংকট থেকে তাদের যে করণীয় আছে, তাদের উপলব্ধিতে আসছে না। প্রতিযোগিতার মাঝে টিকে থাকার জন্য অবশ্যই তাদের নভেম্বর মাস থেকে ব্যানার, ফেস্টুন টানিয়ে ভর্তি কার্যক্রম শুরু করা প্রয়োজন। জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব প্রধান শিক্ষকসহ সব শিক্ষকের। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তেমন কোনো দায় আছে বলে মনে হয় না। তারা ৬ মাস ১/২/৩ বছর পরপর আসা-যাওয়া করে থাকেন। এজন্য এ ব্যাপারে শিক্ষকদের প্রধান দায়িত্ব নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশাল স্বপ্ন এদেশের মানসম্মত শিক্ষা, তথা শিশুশিক্ষা বাস্তবায়ন করা। সবার মধ্যে এ বিষয়টি উদয় হোক এ কামনা করছি।

অভিন্ন ভর্তি প্রক্রিয়া বই, ছুটি, কর্মঘণ্টা ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা : আমাদের দেশের শিক্ষিত, অশিক্ষিত অধিকাংশ জনগণ বিগত সময়ের পাঠদান ও পরীক্ষা ব্যবস্থায় অভ্যস্ত। তাদের বদ্ধমূল ধারণা, শিশুশিক্ষার্থীদের বেশি বেশি বই ভালো পাশের জন্য প্রয়োজন। বাস্তবে অমনোবিজ্ঞানসম্মত মাত্রাতিরিক্ত বই ও মুখস্থ করে ভালো নম্বরপ্রাপ্তি মেধার বিকাশ নয়। এতে মেধার বিনাশ হয়ে থাকে-এ ধারণা আজও তাদের মাঝে জাগ্রত হয়নি। আজও তাদের মাঝে ভ্রান্তধারণা। পরীক্ষা না থাকলে বা পড়ার চাপ না থাকলে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ভেস্তে যাবে। আমাদের শিশুদের প্রয়োজন বেশি বেশি জ্ঞান। তার মানে বড় বড় পাশ নয়। শিক্ষক শিশুর সব শব্দ, বাক্যের বা অধ্যায়ের পরিপূর্ণ জ্ঞান দেবে এবং মূল্যায়ন করে পাঠ সমাপ্ত করে অন্য পাঠে এগিয়ে যাবেন। দুর্বল শিক্ষার্থীদের অধিক যত্ন নিয়ে পাঠের মাধ্যমে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে তুলবেন। এ প্রেক্ষাপটে সব শিশুর জন্য প্রয়োজন অভিন্ন (ভর্তি প্রক্রিয়া, ছুটি, বই, কর্মঘণ্টা ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা)।

শিক্ষক কর্মকর্তা মানসিকতার পরিবর্তন : শিক্ষক ও শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ছিল হৃদয়জুড়ে। সে ভালোবাসার প্রতিদানে চরম অভাব, ধ্বংসস্তূপের মাঝে স্বাধীনতার ঊষালগ্নে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেছেন। নচেৎ বেসরকারি স্কুল, কলেজের শিক্ষকদের মতো এমপিওভুক্তির দাবিতে রাস্তায় চিল্লাচিল্লি করে হয়তো ক্লান্ত দেহ, মন নিয়ে খালি হাতে ঘরে ফিরতে হতো। শিশুশিক্ষার প্রত্যাশা ছিল জাতীয়করণ। এজন্য বঙ্গবন্ধু ও শিক্ষাবান্ধব সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আন্দোলন বা সংগ্রাম করতে হয়নি। প্রধান শিক্ষকরা ২য় শ্রেণি ও সহকারী শিক্ষকের তৃতীয় শ্রেণি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এ মর্যাদা জাতির জন্য গৌরবের নয়। সব শিক্ষকের ১ম শ্রেণি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের শিক্ষকদের কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে না। সরকারিকরণের ফলে আজ সহকারী শিক্ষকরা তাদের ১০ম গ্রেডের জন্য মহামান্য হাইকোর্টে রিট দায়ের করতে পেরেছেন। এ সুযোগ সৃষ্টির জন্য বঙ্গবন্ধুর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। তারই সুযোগ্যকন্যা শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্য ও দেশ পরিচালনার সফলতা কামনা করছি। প্রাথমিক শিক্ষক অহংকার জাতির পিতা ও তারই কন্যার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হিসাবে তারা নিষ্পাপ শিশুদের শিক্ষাদান কার্যে জড়িত মহান সৃষ্টিকর্তার ওপর শোকরিয়া জানিয়ে তাদের অন্যতম ইবাদত শিক্ষাদান কার্য যথাযথভাবে পালন করা। বাংলাদেশে একমাত্র প্রাথমিক শিক্ষকরা লক্ষাধিক প্রতিযোগিতার মধ্যে নির্বাচিত উচ্চশিক্ষিত। উচ্চবিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এত ট্রেনিংপ্রাপ্ত শিক্ষক নেই। এ গর্ব অনুধাবন করে দেশের আনাচে-কানাচে সব শিশুর মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। কর্মকর্তাদের উপলব্ধি করতে হবে, তারা নিষ্পাপ শিশুদের শিক্ষার যথাযথভাবে পরিচালনা, মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে সব ধরনের চ্যালেঞ্জ দূরীকরণের মহাযজ্ঞের কর্মকর্তা। এত কিছুর পরও প্রাথমিক শিক্ষক, কর্মকর্তাদের মাঝে প্রায় মরি-মরি মনোভাব। এ ভাবনা থেকে বেরিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে উপলব্ধি করতে হবে যে, আমরা সর্বাধিক ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মন্ত্রণালয় মাঝে কর্মরত। আমাদের সামনের সারিতে থেকে দেশ ও জনগণের কল্যাণ এগিয়ে যেতে হবে। এ পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষার্থী সংকট দূরীকরণে কতিপয় সুপারিশ উপস্থাপন করছি-

১. যেহেতু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিশু শিক্ষার সব ধরনের সুযোগ সুবিধাসহ পরিবেশ বিদ্যমান। পাশাপাশি উচ্চশিক্ষিত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের সমাহার। বয়স, রুচি, সামর্থ্যানুযায়ী মনোবিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাদানের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শিশুশিক্ষায় তেমন কোনো প্রশিক্ষণ নেই। এ প্রেক্ষাপটে উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাথমিক শিক্ষা বিলুপ্ত করার প্রত্যাশা করছি। জাতীয় শিক্ষানীতির সফল বাস্তবায়নে ও এদেশের তৃণমূলের সাধারণ মানুষের অবৈতনিক শিক্ষার অধিকার বাস্তবায়নে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় দ্রুত ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত খোলার জন্য জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করছি।

২. শিশু শিক্ষার অভিন্ন (ভর্তির কার্যক্রম, ছুটি, বই, কর্মঘণ্টা মূল্যায়ন ব্যবস্থা) থাকা প্রয়োজন।

৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের পদ খালি বিষয়টি জিরো টলারেন্সে নামিয়ে আনতে হবে। শিক্ষকদেরসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমস্যা নিরসনে সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি, চরম শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি শিক্ষক পদ শূন্য রাখা মারাত্মক অপরাধ হিসাবে গণ্য করার দাবি রইল।

৪. সংশ্লিষ্টদের মাঝে শিশুশিক্ষার শিক্ষার্থী সংকট দূরীকরণসহ মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণে আশা করছি। জয় বাংলা।

মো. সিদ্দিকুর রহমান : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ

শেয়ার করুন
এই ধরনের আরও খবর...
themesba-lates1749691102