April 26, 2024, 7:43 pm
ব্রেকিং নিউজ

সংবাদপত্র, সাংবাদিকতা ও আহমদুল কবির

রিপোর্টারের নাম:
  • আপডেট টাইম Thursday, November 24, 2022
  • 147 দেখা হয়েছে

সালাম জুবায়ের :

বাংলাদেশের সংবাদপত্র প্রকাশনা এখন একটি পরিণত অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। নানা আঙ্গিকে নানা চিন্তাচেতনার প্রকাশ থেকে শুরু করে আদর্শগত অবস্থান সংবাদপত্রকে এখন একটি ভিন্ন রূপ দিয়েছে।
দেশের সংবাদপত্র প্রকাশনাকে এ অবস্থায় নিয়ে আসতে বেশ কয়েকজন গুণী সাংবাদিক অবদান রেখেছেন।

তারা সংবাদপত্রে সাংবাদিকতা ও প্রকাশনাকে সৃজনশীল একটি বিষয় হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। এ বরণীয় সাংবাদিক-সম্পাদকদের মধ্যে আহমদুল কবির ছিলেন অগ্রগণ্য।

আহমদুল কবির ছিলেন দেশের অন্যতম প্রাচীন সংবাদপত্র দৈনিক সংবাদের সম্পাদক ও প্রকাশক। সংবাদে তিনি সাংবাদিকতার একটি নতুন ধারা প্রবর্তন করেছিলেন। তার পরবর্তী প্রজন্ম আরও বিচিত্র রূপ ও মাত্রায় সংবাদপত্রকে বিন্যাস করেছেন।

কিন্তু আহমদুল কবিরই প্রথম দেশের সংবাদপত্রকে আধুনিক ও বিষয়বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ করে একটি নতুন অবস্থান তৈরি করেছেন। তার সময়ে আরও অনেক কৃতী, গুণী সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব থাকলেও আহমদুল কবির এক্ষেত্রে দিকপাল হয়ে আছেন।

আহমদুল কবির আবির্ভূত হয়েছিলেন এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে, কিন্তু জীবন কাটিয়েছেন একজন সাধারণ মানুষের মতো। তার সময়ে যেমন, তেমনই অনেক পরেও, অনেক উচ্চমার্গের ব্যক্তিও তাকে সহজসরল ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য ভিন্নমাত্রার মানুষ হিসাবে বিবেচনা করতেন, মূল্যায়ন করতেন। একদিকে ভিন্নমাত্রায় নিজের জীবনকে বিন্যাস করার সক্ষমতা, অন্যদিকে মেধা, পাণ্ডিত্য, পরমতসহিষ্ণুতা আর মুক্তবুদ্ধির ধারক-বাহক-এসব গুণের সন্নিবেশ ঘটেছিল আহমদুল কবিরের মধ্যে।

আহমদুল কবিরের জীবন ছিল দীর্ঘ ৮১ বছরের। এর মধ্যে শিক্ষাজীবনের পর তার প্রগতিশীল কর্মকাণ্ড-সামাজিকতা, সাংবাদিকতা এবং রাজনৈতিক জীবন মিলে কর্মময় জীবন ছিল প্রায় ৬১ বছরের। ১৯৪২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ক্রীড়া সম্পাদক হিসাবে তিনি সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হন। এ ধারাবাহিকতায় ১৯৪৫-৪৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) প্রথম সহসভাপতি নির্বাচিত হন।

এরপর তিনি আর থেমে থাকেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবন শুরু করলেও কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিজেকে সাংবাদিকতা ও রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে ফেলেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ায় যোগ দেন এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ বিভাগের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫০ সালে তিনি পাকিস্তানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন এবং ১৯৫৪ সালে তা ছেড়ে দিয়ে নিজের ব্যবসা শুরু করেন। সে বছরই তিনি দৈনিক সংবাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। ২০০১ সালে প্রধান সম্পাদক হন এবং আমৃত্যু এ দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

দৈনিক সংবাদের দায়িত্ব নিয়ে তিনি যেসব যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগৎকে পথ দেখিয়েছে। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত একটা সময় ছিল, যখন দেশে সংবাদপত্র মানেই ছিল কলকাতার দৈনিক ও সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের সংবাদ পরিবেশন ধারার অনুসরণ। আহমদুল কবির সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখিয়েছিলেন দৈনিক সংবাদের মাধ্যমে। আহমদুল কবির যুগের সঙ্গে, সময়ের নানা ঘটনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বা আধুনিকতাকে ধরে রাখতে দৈনিক সংবাদের অনেক কিছু পরিবর্তন করেছেন। তার হাত ধরে যে নতুন ধারা সংবাদের মাধ্যমে অঙ্কুরিত হয়েছিল, তার আলো এখনো ছড়িয়ে আছে দেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতায়।

অতীতে চোখ ফেরালে দেখা যায়, প্রগতিশীল একজন ব্যবসায়ীর হাত ধরে দৈনিক সংবাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল মূলত সংবাদপত্রে এ দেশীয় একটি ধারা প্রচলনের প্রত্যাশা নিয়েই। কিন্তু নানা কারণে তার পক্ষে সংবাদপত্র চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। একপর্যায়ে দৈনিক সংবাদ চলে যায় রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের হাতে। এরপরই সংবাদের পথ রাজনৈতিক দিকে ঘুরে যায়। তখন পূর্ব পাকিস্তানে ছিল মুসলিম লীগের শাসন।

মুসলিম লীগ ছিল মূলত একটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল। ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের সংবাদপত্র চালানোর ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় নির্বাচনে তাদের ভরাডুবির পর। তখন সংবাদপত্র নিয়ে তাদের আর কিছু করার মতো অবস্থাও ছিল না। এ সময় সংবাদের দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসেন আহমদুল কবির। সেই সময়ে আহমদুল কবির অত্যন্ত শিক্ষিত এবং রাজনৈতিকভাবে মেধাবী ও আদর্শবাদী ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত ছিলেন। প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারায় তিনি দীক্ষিত। দৈনিক সংবাদের জন্মের সময় এর সম্পাদক হিসাবে ছিলেন তখনকার সময়ের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব খায়রুল কবির। তিনি ছিলেন আহমদুল কবিরের বড় ভাই। খায়রুল কবির পরবর্তী সময়ে দেশের ব্যাংকিং জগতের অন্যতম দিকপাল হয়ে উঠেছিলেন।

আহমদুল কবির সংবাদের দায়িত্ব নেওয়ার পর এতে আদর্শ ও চেতনাগত ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। এ পরিবর্তনের পেছনে তার রাজনৈতিক আদর্শ ও দর্শন কাজ করেছে। আহমদুল কবির তার রাজনৈতিক আদর্শের কারণেই নতুন জীবন দিলেন সংবাদকে।

মৃত্যুপথযাত্রী একটি সংবাদপত্রকে তিনি নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজের সংবাদপত্র পড়ার সংস্কৃতিকে তিনি আরও বিস্তৃত করে সাধারণ মানুষের সংগ্রামমুখী জীবন ও আর্থসামাজিক অবস্থার মুখপত্র হিসাবে তুলে ধরলেন। তার এ ভিন্নধর্মী চিন্তার প্রতিফলন ঘটে পরবর্তীকালে অন্য সংবাদপত্রগুলো একই ধরনের পথে চলা শুরু করার মধ্য দিয়ে।

পঞ্চাশের দশকে এ অঞ্চলে সংবাদপত্র পাঠ ছিল উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজের বিষয়। সেই পাঠক পরিধি থেকে বের করে আহমদুল কবির সংবাদপত্রকে ছড়িয়ে দিলেন সাধারণ মানুষের কাছে। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে শিক্ষক, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক থেকে শুরু করে উচ্চমার্গের পেশাজীবীদের পাশাপাশি একজন সাধারণ শ্রমিককেও তিনি সংবাদপত্র পাঠের গণ্ডিতে নিয়ে আসেন।

এ আনাটা সম্ভব হয়েছিল সংবাদপত্রকে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের পাঠযোগ্য করার মধ্য দিয়ে। একজন রাজনৈতিক কর্মী, একজন উচ্চশিক্ষিত শিক্ষাবিদ যেমন তার পাঠযোগ্য বিষয় পান সংবাদপত্রে, তেমনই পাটকল, সুতাকলের একজন সাধারণ শ্রমিকও তার পাঠযোগ্য বিষয় পেলেন দৈনিক সংবাদে। সাধারণ মানুষ তার রাজনৈতিক অধিকারের জন্য আন্দোলন-সংগ্রামের খবর পেলেন দৈনিক সংবাদ পড়ে।

এভাবে একজন প্রান্তিক কৃষকও দৈনিক সংবাদকে তার পাশে পাচ্ছিলেন। কোন মাসে কোন ধান রোপণ করতে হবে, সে খবরটিও সংবাদ খুব যত্নের সঙ্গে বিভিন্ন পাতায় তুলে ধরেছে। যেমন তুলে ধরেছে শিশুদের কথা, নারীদের কথা, ব্যবসায়ীদের কথাও। সেই সময় শিশুদের জন্য আলাদা পাতা; নারীদের জন্য, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য, কৃষকের জন্য-বস্তুত সব পেশার মানুষের জন্য সংবাদ পৃথক পৃথক বিভাগ শুরু করে। দেশে সংবাদপত্রের সেই প্রাথমিক যুগে এটি ছিল একটি অসাধারণ ঘটনা। এখনকার প্রজন্মের পক্ষে ৫০-৬০ বছর আগের সংবাদপত্রের রূপ অনুধাবন করা সম্ভব নয়।

শহরের আড়ম্বরপূর্ণ সমাজের পাশাপাশি গ্রামের নিরাভরণ পরিবেশেও সংবাদপত্র পাঠের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল দৈনিক সংবাদ। সংবাদের রিপোর্টার মোনাজাত উদ্দিন কৃষক ও জনপদের কথা তুলে ধরে বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে একটি ভিন্ন ধারাই সংযোজন করে ফেলেন, যা হলো ‘গ্রামীণ সাংবাদিকতা’ এবং ‘চারণ সাংবাদিকতা’। দেশের সংবাদপত্রের বিষয়ভিত্তিক বিবর্তন নিয়ে যদি গবেষণা হয়, তবে তার সিংহভাগজুড়েই থাকবে দৈনিক সংবাদ, দৈনিক সংবাদের বিভিন্ন বিষয়। আহমদুল কবিরের হাত ধরে আধুনিক শিক্ষায় আলোকিত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সংবাদকে নিজেদের পত্রিকা বলে মনে করতে পেরেছিল, যা পরে অন্য পত্রিকার ভাগ্যেও জুটেছিল।

আজ ২৪ নভেম্বর আহমদুল কবিরের ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রয়াত এ সাংবাদিক-সম্পাদকের প্রতি জানাই শ্রদ্ধা।

সালাম জুবায়ের : সাংবাদিক (সূত্র-যুগান্তর)

শেয়ার করুন
এই ধরনের আরও খবর...
themesba-lates1749691102