মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
‘শাবান’ হিজরি ক্যালেন্ডারে বছরের অষ্টম মাস। এর পরের মাসই পবিত্র ‘মাহে রমজান’। শাবান এলেই চারদিকে ইবাদতের সুবাতাস বইতে শুরু করে। মুমিন হৃদয় জেগে ওঠে। নিজেদের প্রভুপ্রেমে বিলিয়ে দেন বিনিদ্র রজনিতে।
ইবাদত-বন্দেগিতে কাটান দিনের বেশিরভাগ সময়। আসছে রমজানের প্রাক প্রস্তুতি হিসাবে মানসিকভাবে গড়ে তোলার অপূর্ব সুযোগ শাবান মাস। রাসূল (সা.) এ মাসকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। কামনা করতেন রজব-শাবানের বরকত পেয়ে পবিত্র রমজানের ফজিলতে ধন্য হতে। তাই মহান প্রভুর দরবারে মিনতি ভরে গভীর আবেগে দোয়া করতেন-‘আল্লাহুম্মা বা-রিক লানা ফি রাজাবা ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রামাদান।’ অর্থ : হে আল্লাহ! আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দান কর এবং রমজান মাস পর্যন্ত আমাদের পৌঁছে (জীবন) দাও।’ (মুসনাদে আহমাদ : ২৩৪৭)।
রাসূল (সা.) শাবান মাস ইবাদতে মগ্ন থেকে সাহাবায়ে কেরামদেরও আমলের জন্য উৎসাহ দিতেন। এ মাসের গুরুত্বের কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা.) শাবানকে নিজের মাস বলে অভিহিত করেছেন। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রজব হলো আল্লাহর মাস।
সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর মাস রজবকে সম্মান করল, সে আল্লাহর বিধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল। আর যে আল্লাহর বিধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে, মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতুন নাঈমে প্রবেশ করাবেন। আর শাবান হলো আমার মাস। আর যে ব্যক্তি শাবান মাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল সে আমার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল। আর যে আমার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে, কিয়ামতের দিন আমি হব তার অগ্রবর্তী এবং নেকির ভান্ডার। আর রমজান মাস হলো আমার উম্মতের মাস।’ (শুয়াবুল ইমান : হাদিস ৩৫৩২)।
মূলত রমজানের প্রস্তুতি হিসাবে শাবান মাসের অনেক ফজিলত ও বেশকিছু করণীয়ও রয়েছে। প্রথমত শাবানের চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই দিন গণনায় গুরুত্ব দেওয়া। যেন রমজানের রোজা সঠিক সময় আদায় করা সহজ হয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা রমজান ঠিক রাখার জন্য শাবানের চাঁদ গণনা কর।’ (তিরমিজি : ৬৮৭)।
হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আল্লাহর রাসূল (সা.) শাবান মাসের তারিখ এতটাই মনে রাখতেন যতটা অন্য মাসের তারিখ মনে রাখতেন না। শাবানের ২৯ তারিখ চাঁদ দেখা গেলে পরের দিন রমজানের রোজা রাখতেন। আর সেই দিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে শাবান ৩০ দিন পূর্ণ করে রমজানের রোজা শুরু করতেন।’ (আবু দাউদ : ২৩২৭)।
শাবান মাসের অন্যতম একটি আমল হলো, নফল রোজা রেখে আগত রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করা। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, একদা মহানবিকে (সা.) জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! কোন রোজার ফজিলত বেশি? উত্তরে তিনি বললেন, ‘রমজান মাসের সম্মানার্থে শাবান মাসে কৃত রোজার ফজিলত বেশি।
আবার জিজ্ঞেস করা হলো, কোন দানের ফজিলত বেশি? উত্তরে তিনি বললেন, রমজান মাসে কৃত দানের ফজিলত বেশি।’ (বায়হাকি : ৮৭৮)। অন্য এক বর্ণনায় আছে, হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি আল্লাহর রাসূল (সা.)কে বছরের অন্য কোনো মাসে শাবান মাসের চেয়ে বেশি রোজা রাখতে দেখিনি। শাবান মাসে তিনি প্রায় সারা মাসই রোজা রাখতেন। খুব সামান্য কয়েক দিন বাদ যেত।’ (তিরমিজি : ৭৩৬)। অর্থাৎ রোজা রাখার ক্ষেত্রে শাবানের ২৭ তারিখের পরে না যাওয়া।
কেননা, এর পরের দিনগুলো সন্দেহপূর্ণ। হাদিসে এ দিনগুলোতে রোজা রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। হজরত কাতাদাহ (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেন, ‘নবি করিম (সা.) বলেছেন, তোমরা রমজান মাস ও শাবান মাসের মাঝে এক বা দুই দিনের ব্যবধান বজায় রাখ।’ (রোজা রাখা বর্জন করে)।’ (মুসানাফে আবদুর রাজ্জাক : হাদিস ৭৩১৬)।
শাবান মাসের ফজিলতের আরেকটি কারণ হলো, এ মাসের ১৪ তারিখের বরকতময় দিবাগত রাত। যা শবেবরাত হিসাবে প্রসিদ্ধ। এ রাতে ইবাদতের মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘আল্লাহতায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন, ক্ষমাপ্রার্থীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের ওপর অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন।’ (শুআবুল ইমান : ৩৮৩৫)। বোঝা গেল, শাবান হলো আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বিশেষ পুরস্কার ক্ষমা অর্জনের মাস। রমজানকে স্বাগত জানিয়ে নিজের প্রস্তুতি গ্রহণের মাস।
বিশেষত ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে সময় কাটানো। সুতরাং শাবান মাসে নফল রোজা, জিকির, কুরআন তেলাওয়াত, দান-সদকা ও নফল রোজার মাধ্যমে প্রস্তুতি গ্রহণ করে রমজানের জন্য অপেক্ষা করা এবং সব গর্হিত কাজ থেকে দূরে থাকা। আল্লাহতায়ালা শাবান মাসের গুরুত্ব বুঝে আমাদের সবাইকে আমল করার তাওফিক দান করুন।
লেখক : গবেষক, কলামিস্ট