লাবলু আনসার, যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) ভোর ৫টার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলীয় অঙ্গরাজ্য ভার্মন্টে ভোটগ্রহণ শুরু হয়।
মার্কিন ব্যবস্থায় নাগরিকদের সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না। নাগরিকদের ভোট ভাগ হয়ে যায় ৫৩৮টি নির্বাচক (ইলেক্টোরাল) ভোটের মধ্যে। এই ভোটগুলোর বিন্যাস ঠিক করে দেয়, কে হবেন প্রেসিডেন্ট।
যে প্রার্থী জনগণের ভোট জিতে নেন, প্রতিটি রাজ্য তার ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটগুলো ওই প্রার্থীকে দেয়। বড় রাজ্যগুলোর ভাগে ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট বেশি থাকে। সেসব রাজ্যে কংগ্রেসের প্রতিনিধি বেশি।
এবারের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিস। অন্যদিকে রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাদের মধ্যে অন্তত ২৭০টি গুরুত্বপূর্ণ ইলেক্টোরাল ভোট পেতে কঠিন লড়াই হবে। এ সংখ্যাটি প্রেসিডেন্ট হওয়ার নিশ্চয়তা দেবে।
তবে এবারের নির্বাচনের লড়াই একেবারে শেষ সময় পর্যন্ত গড়াতে পারে। বিশেষজ্ঞরা ভোটের ফলাফল প্রকাশে দেরি হওয়ার আশঙ্কা করছেন। এ ছাড়া ভোট গণনা নিয়ে আইনি চ্যালেঞ্জের মতো জটিলতাও তৈরি হতে পারে।
নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে প্রায় ৮ কোটি ১০ লাখ ভোটার এরই মধ্যে আগাম ভোট দিয়েছেন।
স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সকালে ভোটগ্রহণ শুরু হবার পর অধীর আগ্রহে ৩৪ কোটি আমেরিকানের মতো গোটাবিশ্ব তাকিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কে হচ্ছেন? কোন দল পাচ্ছে সিনেট ও হাউজের নেতৃত্ব। রবিবার পর্যন্ত ৮ কোটি আমেরিকান আগাম ভোটে অংশ নেয়ায় ১০ কোটি ভোটার মঙ্গলবার কেন্দ্রে গিয়ে ভোট প্রদানের পরই শুরু হবে ফলাফল ঘোষণার পালা। আর এজন্যে ফলাফল জানতে অপেক্ষা করতে হবে কয়েকদিন। কারণ, ডাকযোগে আসা ব্যালট গননা ব্যতিত অধিকাংশ এলাকার ফলাফল নির্দ্ধারণ করা সম্ভব হবে না। এজন্যে নির্বাচন কর্মকর্তারা নাগরিকদের ধৈর্য ধারণের আহবান জানিয়েছেন।
এমন আহ্বান উচ্চারিত হতো না যদি জনমত জরিপে প্রধান দুই প্রার্থীর মধ্যে বিস্তর ব্যবধান পরিলক্ষিত হতো। বিশেষ করে দোদুল্যমান ৭ স্টেটে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কমলা হ্যারিসের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস ফুটে ওঠায় ফলাফল ঘোষণা বিলম্বিত হবে বলে নির্বাচনি বিশ্লেষক-পর্যবেক্ষক এবং কর্মকর্তারা ধারণা করছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, স্মরণকালের যেকোন নির্বাচনের চেয়ে এবারের নির্বাচনটি আমেরিকানদের ভোট যুদ্ধে সবচেয়ে বেশী উজ্জীবিত করেছে। আগাম ভোটে রিপাবলিকানদের ব্যাপক অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে তা দৃশ্যমান হয়েছে। উল্লেখ্য, ভোটগ্রহণ শেষ হলে অঙ্গরাজ্যসমূহের নির্বাচন কর্মকর্তারা কোন প্রার্থী কত ভোট পেয়েছেন সেই কেন্দ্রে সেটি জানাবেন স্বল্প সময়ের মধ্যে। এরপর তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ডাকযোগে আসা ব্যালট গণনার অপেক্ষায় থাকবেন। এমন প্রক্রিয়া অবলম্বনের জন্যে সর্বশেষ নির্বাচনে জো বাইডেনকে প্রাথমিকভাবে জয়ী ঘোষণায় চারদিন পর্যন্ত সময় লেগেছে।
আর এবারের নির্বাচনেও দোদুল্যমান ৭ রাজ্যের ফলাফল ঘোষণা করতে সময় লাগবে। কারণ পেনসিলভেনিয়া, আরিজোনা, নেভাদা, মিশিগান, উইসকনসিন, জর্জিয়া এবং নর্থ ক্যারলিনায় উভয়ের ভোটের পরিমাণ প্রায় সমান সমান। বিদ্যমান রীতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভোটারের লাইন দীর্ঘতর হলে সকলের ভোট গ্রহণ পর্যন্ত কেন্দ্র খোলা রাখতে হয়। বেশ ক’টি অঙ্গরাজ্যের আবহাওয়া বৈরী থাকার কথা দুপুর পর্যন্ত। সেখানকার ভোটাররা যদি অপরাহ্নে কেন্দ্রে হাজির হন তাহলে গণনার ব্যাপারটিও বিলম্বিত হবে। এছাড়া রয়েছে ডাকযোগে আসা ব্যালটের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন। সর্বশেষ কখন তা নির্বাচন অফিসে এলে তা বৈধ বিবেচিত হবে-এ নিয়ে প্রশ্নের অবতারণা হয়েছে। রিপাবলিকানরা আগেই জানিয়ে রেখেছেন যে, ভোটের দিন অর্থাৎ ৫ নভেম্বর গন্তব্যে পৌঁছা ব্যালটই গণনার আওতায় আসবে। বিদেশে অবস্থানকারী কূটনীতিকসহ সামরিক বাহিনীর সদস্যগণের ব্যালটের ব্যাপারটিও রয়েছে। কারণ, কোন কোন দেশ থেকে নির্বাচনের পরের দিনও আসতে পারে সে সব ব্যালট। ফলাফল খুব কাছাকাছি হলে এসব ব্যালটকেও গণনার প্রয়োজন হবে। আর এমনি অবস্থায় এবারের নির্বাচন এবং ফলাফল নিয়ে কেউই স্বস্তিতে নেই। আধুনিক রাজনীতির ইতিহাসে এমন অনিশ্চয়তার ব্যাপারটি সকলকেই ভাবিয়ে তুলেছে।
রিপাবলিকান পার্টির জাতীয় কমিটির সাবেক কম্যুনিকেশন্স ডাইরেক্টর এবং ভোট-বিশেষজ্ঞ ডোগলাস হেইয়ি মঙ্গলবার সকালে গণমাধ্যমে বলেছেন, অত্যন্ত সততার সাথে বলতে হলে এটাই সঠিক যে, কিছুই জানি না, বুঝতে পারছি না। কারণ সবকিছুতেই ঘোলাটে ভাব। ট্রাম্প না কমলা-এমন একটি দ্বন্দ্ব সকলের মধ্যে বিরাজ করছে। ভোটের গতিবিধি সম্পর্কে কোন আন্দাজই করা যাচ্ছে না। ২০০৮ সালে হিলারি ক্লিন্টনের ক্যাম্পেইন ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারি পট্টি সলিস ডয়েল বলেন, গত তিন যুগের মধ্যে এমন অবস্থা ঘটেনি। কোন কিছুই আন্দাজ করা যাচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর মধ্যে যিনি জয়ী হবেন তার পক্ষেই আসবে প্রতিনিধি পরিষদ-এটা নিশ্চিত করে বলতে পারছি। ইউএস সিনেটে কোন দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে তা বলা যাচ্ছে না। ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানরা সমানে সমান দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যেও। আর এসব দোদুল্যমান স্টেটে ভোটগ্রহণের শেষ সময় হচ্ছে জর্জিয়া সন্ধ্যা ৭টা, নর্থ ক্যারলিনা ৭.৩০, মিশিগান এবং পেনসিলভেনিয়া ৮টা, আরিজোনা এবং উইসকনসিন ৯টা এবং নেভাদায় শেষ হবে রাত ১০টায়। এরপরই কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার পদক্ষেপ নেবেন কর্মকর্তারা। নিউইয়র্কে ভোর ৬টায় শুরু হয়েছে এবং শেষ হবে রাত ৯টায়।
মার্কিন নির্বাচনি ব্যবস্থা অনুযায়ী কেন্দ্রে প্রাপ্ত ফলাফলই বিজয়ের চূড়ান্ত মাপকাঠি নয়। আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাচের মতোই রয়েছে বিজয়ের জন্যে ইলেক্টোরাল কলেজের ২৭০ ভোটের বেশি পাওয়া। কেন্দ্রের গণনার পরই শুরু হয় অন্তর্জালের এই প্রক্রিয়া। নির্বাচনি এলাকা হিসেবে পরিচিত ১০ হাজার প্রেসিঙ্কটে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে ইলেক্টরাল কলেজ নির্ণীত হয়। এজন্যেও সপ্তাহের অধিক সময় লাগতে পারে। ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফলাফল সার্টিফাইড করার সময় পায় স্টেট ইলেকশন বোর্ড। ১৭ ডিসেম্বর স্টেটের নির্বাচকরা অথবা পার্টির নীতি-নির্ধারকেরা ইলেক্টোরাল কলেজে কে কত ভোট পেলেন তা গণনা করেন। ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে এই গণনার ফলাফল অবশ্যই প্রকাশ করতে হয়। এরপর ৬ জানুয়ারিতে নতুন কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট গণনার পর চূড়ান্ত ফলাফল জানানো হবে। তারাই সিদ্ধান্ত দেবেন ৪৭ তম প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০ জানুয়ারিতে শপথ গ্রহণের পর কে ক্ষমতা নেবেন।
সবশেষ নির্বাচনে চূড়ান্ত বিজয়ী নির্ধারণে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারিতে ক্যাপিটল হিলে হামলা হয়েছিল এবং সেই হামলায় বেশ কজন পুলিশ অফিসারসহ আহত হয়েছেন শতশত মানুষ। টার্গেট করা হয়েছিল ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স এবং স্পিকার ন্যান্সি পোলেসিকে। আর এহেন জঙ্গি তৎপরতার নির্দেশ দিয়েছিলেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এবারও তিনি প্রার্থী এবং কমলার বিরুদ্ধে লড়ছেন। তাই সেই দুঃসহ স্মৃতিকে আমলে নিয়ে ওয়াশিংটন মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।