অনলাইন ডেস্ক:
মঙ্গলবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। স্মরণকালের সর্বোচ্চ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে এটি। যা নিয়ে উদ্বিগ্ন গোটা বিশ্ব। রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের ভোটযুদ্ধে কে হতে যাচ্ছেন বিশ্বমোড়ল তা নিয়েই বেশ চিন্তায় পড়েছেন বিভিন্ন দেশের নাগরিক সমাজ। তবে শুরু থেকেই অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে কল্পনার জালে মোড়ানো সেই নির্বাচনের দিকেই নজর রাখছে পুরো বিশ্ব। বিবিসি।
এবারের মার্কিন নির্বাচন নানা কারণে অতি গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এবারই প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত কোনো নারী প্রার্থীর মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার সর্বোচ্চ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ভোটযুদ্ধে জয় পেলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসাবে ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হবেন কমলা। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প। কোনো অংশে কম নন তিনিও। এগিয়ে আছেন সমানে সমানে। এই হাড্ডাহাড্ডি ভোটযুদ্ধের ফলাফলের অপেক্ষায় রয়েছে বিশ্ব। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা এবং দখলদার ইসরাইল দুই দেশের নাগরিকরাও তাকিয়ে আছেন নির্বাচনের দিকে।
ফিলিস্তিনি-মার্কিন উদ্যোক্তা জামাল জাগুলুল তার জলপাই মাড়াইয়ের যন্ত্রটির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু তার মন পড়ে আছে, হাজার মাইল দূরে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে। পশ্চিম তীরের তারমাস আয়া অঞ্চলে ফিলিস্তিনি-মার্কিনরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের পর ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসবে কি না তা নিয়ে স্থানীয় অন্য মার্কিন পাসপোর্টধারীদের মতো সন্দেহ দানা বেঁধেছে তার মনেও। তিনি বলেছেন, আমরা এখানে অনেক সমস্যায় আছি। যুক্তরাষ্ট্রের কেউই আমাদের নিয়ে ভাবেন না।
জামাল আরও বলেছেন, এবার আমরা পরিবর্তন চাই। আমরা আরেকটি দলকে চাই। আরেকটি স্বাধীন ভিন্ন দল। কেউ আমাদের সাহায্য করছে না। জাগলুলের বন্ধু বাসিম সাবরিও ফিলিস্তিন ও যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী। তিনিও এবার তৃতীয় কোনো দলের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। কারণ, গত আট বছরে যারা সরকারে ছিলেন তারা দুর্দশা ডেকে এনেছেন বলে মনে করেন বাসিম। গাজা যুদ্ধ বাসিমের মনে গভীর দাগ কেটেছে।
গাজা যুদ্ধের শুরু থেকেই ইসরাইলকে একতরফা সমর্থন দিয়ে আসছে বাইডেন প্রশাসন। অস্ত্র এবং আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সাহায্য করছে দেশটিকে। তবে, এবার যুদ্ধের ইতি টানতে চান সাধারণ মানুষ। তাই, বেশিরভাগ ইসরাইলি ঝুঁকছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে। যুদ্ধবিরতি আলোচনায় এবং বন্দিমুক্তিতে ট্রাম্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে ধারণা করছেন অনেকেই। ইসরাইলিরা যেখানে ট্রাম্প নাকি কমলা দ্বন্দ্বে বিভক্ত, গাজাবাসী সেখানে সন্দিহান যে আদৌ মার্কিন নির্বাচন তাদের ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে কিনা। তবে কেউ কেউ বিশ্বাস করেন নতুন প্রেসিডেন্ট অবরুদ্ধ এই অঞ্চলে রক্তপাত বন্ধ করবেন। আবার অনেকের মতে, মার্কিন নির্বাচনে ইসরাইলিদের লাভ হলেও গাজাবাসীর পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন আসবে না।
ট্রাম্প কিংবা কমলা, যিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না কেন, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনতে কতটুকু কার্যকর হবে তা বলা মুশকিল। তবে, নির্বাচনি প্রচারণা চলাকালে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান দলীয় দুই নেতা যুদ্ধবিরতির কথা উল্লেখ করলেও, দু’জনই ইসরাইলের পক্ষ নিয়েছেন। দুই প্রার্থীই গাজায় বোমাবর্ষণ, খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করা, চিকিৎসার সুযোগ না দেওয়া, রোগের বিস্তার ঘটানো এবং জোরপূর্বক স্থানান্তর প্রভৃতি ভয়ঙ্কর নীতির প্রশ্নে নিশ্চুপ। সুতরাং নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক না কেন মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত নিরসনের সম্ভাবনা শূন্য। যার জেরে চিন্তিত গাজাবাসী।
অন্যদিকে চীনের সাধারণ জনগণও অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে নজর রাখছেন। অবশ্য তাদের মধ্যেও কিছুটা শঙ্কাও কাজ করছে। নির্বাচনে জিতে যে-ই হোয়াইট হাউসে যান না কেন তারপর দেশে-বিদেশে কী ঘটতে পারে সেটি নিয়েই কিছুটা ভয় দেখা যাচ্ছে চীনা নাগরিকদের মধ্যে। জিয়াঙ নামের ষাটোর্ধ্ব একজন চীনা নাগরিক বলেছেন, আমাদের মধ্যে কেউই যুদ্ধ দেখতে চাই না। চীন-মার্কিন সম্পর্কে টানাপড়েন ক্রমেই বেড়ে যাওয়ায় চিন্তায় পড়েছেন জিয়াঙ।
এদিকে ইউক্রেনের নাগরিক ইনানা বলেছেন, আমরা অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফল নিয়ে চিন্তায় আছি। কারণ, আমরা শত্রুকে (রাশিয়া) পরাজিত করতে চাই। ইনানা জানেন তার দেশের ভাগ্য ঝুলছে পাঁচ হাজার মাইলেরও বেশি দূরের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ভোটারদের হাতে। তিনি আশাবাদী কমলা জয়ী হবেন এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে সমর্থন করবেন। জয়ী হলে ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখবেন বলে জানিয়েছেন কমলা।
অন্যদিকে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কাজ করবেন। রাশিয়ার কাছে ইউক্রেনকে কিছু ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে হতে পারে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। গাজা-ইউক্রেন ছাড়াও রাশিয়ার নজরও এখন মার্কিন নির্বাচনের দিকে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক বিরাজ করায় মস্কোর আগ্রহ অন্যদের চেয়ে বরং বেশিই থাকার কথা।
২০১৬ সালের নভেম্বরের নির্বাচনে যখন প্রেসিডেন্ট হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হলেন তখন রাশিয়ার উগ্র-জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ ভ্লাদিমির ঝিরিনোভস্কির আনন্দ ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে এবারের নির্বাচনে কোনো রুশ রাজনীতিবিদ বা কর্মকর্তা এখন পর্যন্ত ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে জয়লাভের সম্ভাবনার বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে এসব আলাপ-আলোচনার বাইরে মার্কিন নির্বাচন শেষ পর্যন্ত কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে যাচ্ছে সেটা রাশিয়ার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা নির্বাচন যদি তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় এবং ট্রাম্প ও কমলার মধ্যে একজন যদি সামান্য ব্যবধানে হেরে যান সেক্ষেত্রে দু’পক্ষের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও রেষারেষি-বিতর্ক বেড়ে যাবে। এতে সারা দেশে নির্বাচন পরবর্তী বিশৃঙ্খলা, বিভ্রান্তি এবং সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়বে। ফলে সেগুলো ঠেকাতেই মার্কিন সরকার ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈদেশিক নীতির বিষয়ে তাদের মনোযোগ কম থাকবে বলে মনে করেন অনেকেই।