ড. মো. আল-মামুন
পাটচাষ ও পাটশিল্পের সঙ্গে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জড়িত। পাটশিল্প হলো বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ভারী শিল্প, যা ছিল ব্রিটিশ শাসনামল এবং পাকিস্তানি আমলের একক বৃহত্তম শিল্প। বর্তমান বিশ্বের পাট ও পাটজাত দ্রব্যের বৈদেশিক রপ্তানি আয়ের বৃহদাংশই বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যা মোট বিশ্ববাজারের প্রায় ৬৫ শতাংশ। আমাদের দেশেই পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত মানের পাট উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় তিন শতাংশ আসে পাট থেকে এবং দেশের জিডিপিতে এর অবদান প্রায় তিন শতাংশ। প্রতিবছর প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা কৃষক পেয়ে থাকে পাট আঁশ ও পাটখড়ি বিক্রি করে। এ দেশের প্রায় ৪০ লাখ কৃষক পাটের ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। এছাড়া কাঁচা পাট ও পাটজাত দ্রব্য বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষেত্রে রাজস্ব আয়ের একটি বড় উৎসে পরিণত হচ্ছে।
পাট দেশের কর্মসংস্থানে বিরাট সহায়ক ভূমিকা পালন করছে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বিস্তৃতভাবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ লাখ ২১ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়। পাট অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বছরে দেশে ৮৫ থেকে ৯০ লাখ বেল কাঁচা পাট উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে বেসরকারি পাটকলগুলোর জন্য বছরে ৬০ লাখ বেল কাঁচা পাট প্রয়োজন। আর গৃহস্থালিতে ব্যবহারের জন্য দরকার পাঁচ লাখ বেল। পাট খাতের বৈশ্বিক রপ্তানি আয়ের ৭২ শতাংশ এখন বাংলাদেশের দখলে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে পাট ও পাটপণ্য রপ্তানিতে ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার আয় হয়েছে। এর মধ্যে কাঁচা পাট রপ্তানি থেকে এসেছে ২১ কোটি ৬১ লাখ ৮০ হাজার ডলার। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে কেবল পাটজাত ব্যাগের চাহিদা ১০ থেকে ৭০ কোটিতে উন্নীত হয়েছে এবং অন্যান্য পাটপণ্যের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৭১৭ কোটি টাকার।
পাট খাতের উন্নয়নের জন্য পাট ও পাটজাত পণ্যকে ২০২৩ সালের ‘প্রোডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ বা বর্ষপণ্য এবং পাটকে কৃষিজাত পণ্য হিসাবে গণ্য করার সানুগ্রহ ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাট এখন থেকে কৃষিজাত পণ্য হিসাবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত হবে। কৃষি বিপণন আইন অনুসারে কৃষিপণ্য হিসাবে এখন থেকে পাটের সর্বনিম্ন মূল্য ও যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়ন করবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। পাশাপাশি পাটপণ্যের মূল্য সংযোজন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কার্যক্রমে সহায়তা, অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ এবং শিল্প ও ব্যবসার উন্নয়ন, প্রসার, বিপণন কার্যপদ্ধতি উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সুবিধা পাবে। ইতোমধ্যে পাটচাষিদের কৃষিঋণ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিজেএমসির অধীন বন্ধ ঘোষিত মিলগুলোর পাওনা ও অন্যান্য দায়-দেনা পরিশোধে ৫৭৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার।
কাঁচাপাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে প্রণোদনাসহ পাটকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য গৃহীত হয়েছে সরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপ। এর মধ্যে পাট ও পাটজাত পণ্যের উৎপাদন ও প্রসার, গবেষণা ও পাটচাষে উদ্বুদ্ধকরণে পাট আইন-২০১৫, পাটনীতি-২০১৫, বস্ত্রশিল্প প্রতিষ্ঠান আইন-২০১৫ ও বস্ত্রনীতি-২০১৫ প্রণয়নের উদ্যোগ অন্যতম। পাটচাষিদের সহায়তা করার জন্য একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে পাটের বীজ উৎপাদনে ভর্তুকি প্রদান করা হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় সার, চিনি, ধান, চালসহ ১৭টি পণ্য বিক্রয়, বিতরণ ও সরবরাহে বাধ্যতামূলক পাটজাত মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০’ প্রণীত হয়েছে। পাটকে বিশ্ববাজারে তুলে ধরতে ঢাকার বুকে তেজগাঁওয়ে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারে (জেডিপিসি) প্রায় ২৫০ প্রকার বহুমুখী পাটপণ্যের স্থায়ী প্রদর্শনী ও বিক্রয়কেন্দ্র চালু হয়েছে। রপ্তানিমুখী পাটপণ্য বহুমুখীকরণে নগদ সহায়তা বৃদ্ধি করে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন করে ইউরোপের দেশগুলোতে পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাটশিল্পের পুনরুজ্জীবন ও আধুনিকায়নের ধারা বেগবান করা এবং বাংলাদেশের পাটকে সারা পৃথিবীর কাছে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে ২০১৬ সাল থেকে ৬ মার্চ দেশব্যাপী জাতীয় পাট দিবস উদ্যাপন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের পাট এখন পশ্চিমা বিশ্বের গাড়ি নির্মাণ, পেপার অ্যান্ড পাম্প, ইনসুলেশন শিল্পে, জিওটেক্সটাইল হেলথ কেয়ার, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্পিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিক্স, মেরিন ও স্পোর্টস শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাট ও পাটজাত বর্জ্যরে সেলুলোজ থেকে পরিবেশবান্ধব বিশেষ সোনালি ব্যাগ, পাটের তৈরি জিন্স (ডেনিম), পাট ও তুলার মিশ্রণে তৈরি বিশেষ সুতা (ভেসিকল), পাট কাটিংস ও নিম্নমানের পাটের সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে নারিকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণে প্রস্তুত জুট জিওটেক্সটাইল, পাটখড়ি থেকে উৎপাদিত ছাপাখানার বিশেষ কালি (চারকোল) এবং পাট পাতা থেকে উৎপাদিত ভেষজ পানীয় দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। পাট দিয়ে তৈরি শাড়ি, লুঙ্গি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, বাহারি ব্যাগ, খেলনা, শোপিস, ওয়ালমেট, আল্পনা, দৃশ্যাবলি, নকশিকাঁথা, পাপোশ, জুতা, স্যান্ডেল, শিকা, দড়ি, সুতলি, দরজা-জানালার পর্দার কাপড়, গয়না ও গয়নার বক্সসহ ২৩৫ রকমের আকর্ষণীয় ও মূল্যবান পণ্য দেশে ও বিদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে।
জলবায়ু আন্দোলনের অংশ হিসাবে পানি, মাটি ও বায়ুদূষণকারী পলিব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র জনমত তৈরি হয়েছে। উন্নত দেশগুলোয় পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশ বিপর্যয়কারী কৃত্রিম তন্তুর জনপ্রিয়তা বা ব্যবহার ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। তাছাড়া জাতিসংঘ কর্তৃক ২০০৯ সালকে ‘আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক তন্তু বর্ষ’ হিসাবে ঘোষিত ও পালিত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক তন্তুর ব্যবহার আরও উৎসাহিত হয়েছে। বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি এবং বছরে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন টন পলিথিন ব্যবহার করা হয়, যার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার মানুষ ছাড়াও বিপুলসংখ্যক পাখি ও জলজ প্রাণী। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে শুধু ঢাকাতেই মাসে প্রায় ৪১ কোটি পলিব্যাগ ব্যবহার করা হয়। এসবের ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যশস্য ও চিনি মোড়কীকরণ করার জন্য পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা বা থলে ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। বাংলাদেশে ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।
বিশ্বব্যাপী পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ার ফলে পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর শিল্প-রাসায়নিক দ্রব্যসামগ্রীর পরিবর্তে অর্গানিক বা পচনশীল ও নবায়নযোগ্য দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা বাড়ছে। সাম্প্রতিককালে ইতালি, ব্রাজিল, ভুটান, চীন, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, তাইওয়ান, তানজানিয়া, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সিনথেটিক ব্যাগসহ পরিবেশবিনাশী বিভিন্ন উপাদান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ঝুঁকে পড়ছে প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারের দিকে। এক্ষেত্রে পাটই হয়ে উঠেছে প্রধান বিকল্প। বিশ্বে বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় ৫০০ বিলিয়ন পাটের ব্যাগ ও ৩২ মিলিয়ন ফুড গ্রেড পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। এর ১০ শতাংশ বাজার দখল করতে পারলে বছরে আয় করা সম্ভব ৫০ হাজার কোটি টাকা। তাছাড়া বিলাসবহুল মোটরগাড়ি নির্মাণ করে এমন পাঁচটি বড় কোম্পানি ঘোষণা দিয়েছে, তারা তাদের গাড়ির অভ্যন্তরীণ কাঠামোর একটি বড় অংশ তৈরি করবে পাটজাত পণ্য দিয়ে। বিশ্বের এ চাহিদা মেটাতে পাটকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে আমাদের কাজ করতে হবে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাটচাষের উন্নয়ন ও পাট আঁশের বহুমুখী ব্যবহারের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য এর আধুনিকায়নের কোনো বিকল্প নেই। পণ্য বৈচিত্র্যকরণে সরকারি পাটকলগুলোয় আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন এবং উৎপাদন স্থিতিশীল রাখার জন্য পাটের ন্যূনতম বাজারমূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি ও মাটি পাট উৎপাদনের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায় বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা রয়েছে। শিল্প ও প্রক্রিয়াজাতকারীদের সুবিধা দিতে হলে পাটকে কৃষিপণ্যের পাশাপাশি কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের তৈরি পণ্যের বিকল্প হিসাবে আমরা পাট ব্যবহার করলে একদিকে পরিবেশ, অন্যদিকে পাটকলগুলো রক্ষা পাবে। দেশের প্রায় ৪ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাট খাতের ওপর নির্ভরশীল। এ খাতে সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে দেশীয় উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিতে হবে এবং ছোট কারখানাগুলোকে সমবায়ের মাধ্যমে বড় আকারের উৎপাদনে কাজে লাগাতে হবে।
পাট ও পাটপণ্য শুধু পরিবেশবান্ধব এবং সহজে পচনশীলই নয়, এটি পরিবেশকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় পরিবেশবান্ধব তন্তু হিসাবে আবার পাটের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই সারা বিশ্বে তিনগুণ বেড়ে যাবে। ফলে পাটপণ্যের বিশাল বাজার সৃষ্টি হবে। দুনিয়াব্যাপী পাটের ব্যাগের চাহিদা বৃদ্ধি এবং আমাদের দেশের উন্নতমানের পাট-এ দুই হাতিয়ার কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশেরও সফলতা আসতে পারে। যে দেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জীবনরহস্য আবিষ্কার করতে পারেন, যে দেশ বহির্বিশ্বে সোনালি আঁশের দেশ হিসাবে পরিচিত, সেই দেশের পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনা কঠিন নয়। মানসম্মত পাট উৎপাদন ও পণ্য বহুমুখীকরণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে স্বদেশি পাটপণ্যের কার্যকর ব্রান্ডিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া এবং পাটপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে আইনগত প্রতিবন্ধকতা দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, গ্রিন ইকোনমি ও সবুজ পৃথিবীর বাস্তবতায় বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় সোনালি আঁশের হারানো সোনালি দিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
কৃষিবিদ ড. মো. আল-মামুন : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট
almamunbjri@gmail.com