অনলাইন ডেস্ক:
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে অপেক্ষার পালা শেষ। মার্কিন জনগণ মঙ্গলবার ভোটের মাধ্যমে নিজেদের পছন্দমতো প্রেসিডেন্ট বেছে নেবেন। রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ডেমোক্রেট প্রার্থী কমলা হ্যারিস দুজনই এখন দাঁড়িয়ে আছেন ইতিহাসের সামনে। আজকের ভোটব্যাংক নিজের পক্ষে টানতে শেষ দিনের প্রচারেও তারা ঘাম ঝরিয়েছেন।
রোববার শক্তিশালী দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য মিশিগানে আরব আমেরিকানদের আশাবাদী কমলা নির্বাচিত হলে ফিলিস্তিনের যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘নতুন করে শুরু করতে তৈরি আমেরিকা।’ আর ট্রাম্প আরেক দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য পেনসিলভেনিয়ার সমাবেশে নির্বাচন ঘিরে ভুয়া সংবাদ সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘বিজয় ছিনিয়ে নিতে ডেমক্র্যাটরা মরিয়া হয়ে উঠেছে।’ খবর বিবিসি, সিএনএন, রয়টার্স ও আলজাজিরার।
মঙ্গলবার অধিকাংশ অঙ্গরাজ্যে ভোটকেন্দ্র খুলবে স্থানীয় সময় সকাল ৭টা থেকে সকাল ৯টার মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র একাধিক ‘টাইম জোনে’ বিভক্ত হওয়ায় সময়ের এমন পার্থক্যে ভোট কেন্দ্র খোলা হবে। একইভাবে, বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ভোট শেষ হওয়ার সময়ও ভিন্ন হবে। তবে অধিকাংশ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শেষ হবে ইস্টার্ন টাইম সন্ধ্যা ৬টা ও মিডনাইট ইস্টার্ন টাইমের (বাংলাদেশ সময় বুধবার ভোর চারটা থেকে রাত ১০টার) মধ্যে। ভোটকেন্দ্র প্রথম বন্ধ হওয়ার (ইস্টার্ন টাইম সন্ধ্যা ৬টা) সঙ্গে সঙ্গেই ভোট গণনার কাজ শুরু হবে। এর কয়েক ঘণ্টা পরই ফলাফল আসতে শুরু করবে।
বিভিন্ন জনমত জরিপ বিশ্লেষণ করে এবারের মার্কিন নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া গেছে। ৬০ বছর বয়সি ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা নারীদের কাছ থেকে জোরালো সমর্থন পাচ্ছেন। আর ৭৮ বছর বয়সি সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশেষ করে পুরুষ হিসপানিক ভোটারদের সমর্থন লাভ পাচ্ছেন। সার্বিক বিচারে শেষ মুহূর্তেও কিঞ্চিৎ ব্যবধানে এগিয়ে আছেন ট্রাম্পই।
রয়টার্স/ইপসস জরিপে দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্প-কমলা দুজনই এবারের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সমর্থন জোগাতে ব্যর্থ হয়েছেন। দুজনকে নিয়েই ভোটারদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। তবে, তাতে ভোটদানে ভাটা পড়েনি। বরং, এবারের মার্কিন নির্বাচনেই এই শতাব্দীর সবচেয়ে বেশি ভোট কাস্টিংয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার ইলেকশন ল্যাব অনুসারে, ইতোমধ্যেই ৭৮ মিলিয়নেরও বেশি আমেরিকান আগাম ভোট দিয়েছেন। ২০২০ সালে মিলিয়ে ভোট পড়েছিল ১৬০ মিলিয়ন।
আমেরিকায় কিছু অঙ্গরাজ্য সচরাচর ডেমোক্রেটদের, কিছু রাজ্য রিপাবলিকানদের সমর্থন করে। কিছু রাজ্যের ক্ষেত্রে এরকম ধরাবাঁধা হিসাব চলে না। তারা কখনো ডেমোক্রেট আবার কখনো রিপাবলিকানদের বেছে নেয়। এগুলোই বলা হয় সুইং স্টেট বা দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য। তারাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকে। তাই সুইং স্টেটকে প্রার্থীরা এতটা গুরুত্ব দেন।
রোববার মিশিগানের প্রচারে কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট হিসাবে ট্রাম্পকে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত করার বিষয়ে হুঁশিয়ারি দেন। সেই সঙ্গে তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে আমেরিকায় নেতৃত্বের নতুন ধারা শুরু হবে। ডেট্রয়েটের গ্রেটার ইমানুয়েল ইনস্টিটিউশনাল চার্চ অব গড ইন ক্রাইস্ট-এর প্যারিশনারদের কমলা বলেন, ‘ঈশ্বর আমাদের জন্য যা নির্ধারণ করে রেখেছেন, তাকে বাস্তবে রূপায়ণ করতে গেলে আমাদের কাজ করে দেখাতে হবে। আমরা যেন সেই পরিকল্পনা মতো কাজ করি। গণতন্ত্রের জন্য, আমাদের সম্প্রদায়ের জন্য, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের জন্য আমরা যেন কাজ করি।’
তিনি বলেন, মঙ্গলবার আমরা আমাদের জাতির ভাগ্য পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নির্ধারণ করার ক্ষমতা অর্জন করব। সেজন্য আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। তাই শুধু প্রার্থনা করা যথেষ্ট নয়, শুধু কথা বলাও যথেষ্ট নয়।
কমলা বলেন, ‘মঙ্গলবার যে নির্বাচন হবে, তাতে বিশৃঙ্খলা, ভয় ও ঘৃণাকে রোধ করার একটি সুযোগ আছে।’ তিনি সামাজিকমাধ্যমে জানিয়েছেন, তিনি মেইল ইন বা পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দিয়েছেন। তার সেই ব্যালট এখন ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে যাচ্ছে। কমলা বলেন, ‘আপনাদের স্বরই আপনাদের ভোট, আপনাদের ভোট মানে আপনাদের ক্ষমতা।’
পরে মিশিগানের ইস্ট ল্যানসিংয়ে একটি সমাবেশে প্রায় দুই লাখ আরব আমেরিকানদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে গাজা ও লেবাননে ইসরাইলি যুদ্ধে বেসামরিক হতাহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কমলা বলেন, প্রেসিডেন্ট হিসাবে আমি গাজার যুদ্ধ শেষ করতে আমার সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করব। সমাবেশে তিনি বিজয়ী হলে গাজা যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও ঠিক কিভাবে সেটা করবেন তার বিস্তারিত কোনো ব্যাখ্যা কমলা দেননি। ট্রাম্পও শুক্রবার মিশিগান সফরে গিয়ে গাজা যুদ্ধ সমাপ্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনো রূপরেখা দেননি।
নির্বাচিত হলে প্রথম দিন থেকেই মার্কিন জনগণের জীবনযাত্রার খরচ কমানোর দিকে মনোযোগ দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কমলা হ্যারিস। তার দেওয়া প্রতিশ্রুতির মধ্যে রয়েছে খাদ্যসামগ্রীর মূল্য নিয়ন্ত্রণ, প্রথমবারের মতো বাড়ি কেনার সুবিধা, আবাসনের ব্যবস্থা ও ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি। কমলা হ্যারিস নির্বাচনি প্রচারে সবচেয়ে আকর্ষণীয় অঙ্গীকার হচ্ছে গর্ভপাতের অধিকার। মূলত এই প্রতিশ্রুতির কারণেই মার্কিন নারীদের সমর্থন অনেকটা তার দিকে ঝুঁকে গেছে।
অন্যদিকে প্রচারের শেষ দিনে রোববার তিনটি সমাবেশ করেন ট্রাম্প। এসব সমাবেশে তিনি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ‘মরিয়া হয়ে ভোট চুরি করার’ অভিযোগ করেছেন। প্রথম সমাবেশে কমলার পক্ষে অগ্রগতি দেখানোর জন্য তিনি বিভিন্ন জরিপের সমালোচনা করেন। পেনসিলভানিয়ায় দেওয়া ভাষণে ডোনাল্ড ট্রাম্প কমলা হ্যারিসের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। তার বদলে ডেমোক্রেটিক পার্টির সমালোচনা করে ক্ষোভ প্রকাশ করে এ দলকে ‘অসুর বা দানব’ বলে অভিহিত করেন। পাশাপাশি ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে নিয়েও তিনি উপহাস করেন এবং আপেলের উচ্চমূল্যের সমালোচনা করেন। এ ছাড়া ডেমোক্রেটদের সমর্থন দেওয়ার জন্য তিনি সংবাদমাধ্যমগুলোর সমালোচনাও করেন।
ট্রাম্প বলেন, তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টি নামক একটি দুর্নীতিগ্রস্ত মেশিনের বিরুদ্ধে লড়ছেন। যদি নির্বাচিত হতে পারেন, তাহলে তিনি পুরো ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনবেন। তিনি বলেন, ‘আমি অনুপ্রবেশ বন্ধ করে দেব। জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিসের সৌজন্যে বিশাল সংখ্যায় অপরাধীরা আমেরিকায় ঢুকছে। ট্রাম্প বলেন, নির্বাচিত হলে তিনি দেশকে নতুন স্বর্ণযুগে নিয়ে যাবেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘গতবার ওরা চুরি করে নির্বাচনে জিতেছিল। এবারও ভোটিং মেশিনে জালিয়াতির মাধ্যমে জয় নিতে চায়। এজন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে।’
জুলাইয়ে পেনসিলভানিয়ার বাটলারেই সমাবেশকালে হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছিলেন ট্রাম্প। রোববার সমর্থকদের কাছে তিনি অভিযোগ করেন, তার চার পাশে বুলেটপ্রুফ কাচের ব্যবস্থায় ফাঁক ছিল। সংবাদমাধ্যমগুলোকে কটাক্ষ করে তিনি বলেন, ‘আমাকে আবারও গুলি করা হতে পারে। আর সেই গুলি আসতে পারে ভুয়া সংবাদের মাধ্যমে। তবে, আমি এটা নিয়ে খুব বেশি কিছু মনে করব না।’
পরে নর্থ ক্যারোলিনার কিন্সটন এবং জর্জিয়ার ম্যাকনে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প গত সপ্তাহের চাকরির প্রতিবেদন নিয়ে কথা বলেন। বর্তমান সরকারের সমালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন অর্থনীতি গত মাসে মাত্র ১২ হাজার কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। তিনি বলেন, এই প্রতিবেদন প্রমাণ করে যে যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘অবক্ষয়িত জাতি’। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ১৯২৯ সালের মহামন্দার পুনরাবৃত্তি হতে পারে বলেও তিনি সতর্ক করেন!
নির্বাচনে জয়ী হলে ডোনাল্ড ট্রাম্প সার্বিক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে জীবনযাত্রাকে সাশ্রয়ী করার অঙ্গীকার করেছেন। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী তেল উৎপাদন বাড়িয়ে জ্বালানির দাম কমানো হবে।
রোববার পেনসিলভানিয়ায় ভাষণের শেষের দিকে ট্রাম্প দাবি করেন, ২০২০ সালে তার পরাজয় হয়েছিল জালিয়াতির কারণে। ট্রাম্প বলেন, নির্বাচনের ফলাফল নির্বাচনের রাতেই ঘোষণা করা উচিত। তবে, একাধিক রাজ্যের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চূড়ান্ত ফলাফল জানতে কয়েক দিন সময় লাগতে পারে।
ট্রাম্প ইতোমেধ্যই ইঙ্গিত দিয়েছেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনের হারলে সেই ফলাফল তিনি মেনে নেবেন না। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ট্রাম্প একাধিকবার বলেছেন, তিনি যদি ২০২৪ সালের নির্বাচনে হেরে যান, তবে এর একমাত্র যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা হবে, ডেমোক্রেটরা তার সঙ্গে ‘প্রতারণা’ করেছে।