মুফতি তোফায়েল গাজালি
বছর ঘুরে আবার এলো ঈদুল আজহা। এ ঈদের অন্যতম প্রধান ইবাদত কুরবানি। আল্লাহর নবি হজরত ইবরাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.)-এর অতুলনীয় নিষ্ঠা ও অপূর্ব ত্যাগের পুণ্য স্মৃতি বহন করে এ দিন সমগ্র বিশ্বের মুসলমান পশু কুরবানি করে থাকেন। মুসলমানরা কুরবানির মাধ্যমে মূলত মনের পশুকে হত্যা করে আল্লাহর দরবারে কায়মনে এ কথা বলেন, হে আল্লাহ! আমাদের জান-মাল, জীবন-মৃত্যু তোমার জন্য উৎসর্গিত। তোমার সন্তুষ্টির জন্য আমরা যেমন পশু জবাই করছি তেমনি যে কোনো ত্যাগের জন্যও প্রস্তুত রয়েছি। কুরবানির মাসআলা-মাসায়িল ও বিধিবিধান নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন-মুফতি তোফায়েল গাজালি
কুরবানির ইতিহাস
হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর অনুসরণে মুসলমানরা যুগযুগ থেকে কুরবানি পালন করে আসছেন। পবিত্র কুরআনে কুরবানির ইতিহাস বিবৃত হয়েছে এভাবে-‘অতঃপর যখন সে (ইসমাইল) তার (ইবরাহিমের) সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছল, তখন সে বলল, ‘হে প্রিয় বৎস, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবেহ করছি, অতএব, দেখ তোমার কী অভিমত? সে বলল, ‘হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তাই করুন। আমাকে ইনশাআল্লাহ আপনি অবশ্যই ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। অতঃপর বাবা-ছেলে উভয়েই যখন আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহিম (আ.) তাকে (ইসমাইলকে) জবাই করার জন্য কাত করে শুইয়ে দিলেন। তখন আমি ডেকে বললাম, ‘হে ইবরাহিম! তুমি তো স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে দেখালে। নিশ্চয়ই আমি এভাবে সৎকর্মপরায়ণদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। ‘নিশ্চয়ই এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি তার (সন্তানের) পরিবর্তে জবাইযোগ্য এক মহান জন্তু দিয়ে (কুরবানি করিয়ে) তাকে (সন্তানকে) মুক্ত করে নিলাম। আর এ (কুরবানির) বিষয়টি পরবর্তীদের জন্য স্মরণীয় করে রাখলাম। (সূরা সাফফাত ১০২-১০৮)।
ফজিলত
সামর্থ্যবান নর-নারীর ওপর কুরবানি ওয়াজিব। এটি মৌলিক ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ বলেন, ‘অতএব, আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কুরবানি আদায় করুন।’ (সূরা কাউসার-২)।
উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কুরবানির দিনের আমলগুলোর মধ্য থেকে পশু কুরবানি করার চেয়ে কোনো আমল আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় নয়। কিয়ামতের দিন এ কুরবানিকে তার শিং, পশম ও খুরসহ উপস্থিত করা হবে। আর কুরবানির রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কুরবানি কর। (জামে তিরমিজি-১৪৯৩)।
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি এ ইবাদত পালন করে না তার ব্যাপারে হাদিস শরিফে কঠোর ধমকি এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যার কুরবানির সামর্থ্য আছে তবুও সে কুরবানি করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ মুসনাদে আহমদ ২/৩২১; মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদিস : ৭৬৩৯।
কার ওপর ওয়াজিব
মাসআলা : প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনাতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার ওপর কুরবানি করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা, অলংকার, বর্তমানে বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমি, প্রয়োজনাতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সব আসবাবপত্র কুরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।
আর নিসাব হলো স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রুপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি। টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নিসাব হলো সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রুপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজনাতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায়, তাহলেও তার ওপর কুরবানি করা ওয়াজিব। যেমন কারও কাছে কিছু স্বর্ণ ও কিছু টাকা আছে, যা সর্বমোট সাড়ে বায়ান্ন তোলা চাঁদির মূল্য সমান হয় তাহলে তার ওপরও কুরবানি ওয়াজিব।
মাসআলা : একান্নভুক্ত পরিবারের মধ্যে একাধিক ব্যক্তির ওপর কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্ত পাওয়া গেলে অর্থাৎ তাদের কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে তাদের প্রত্যেকের ওপর ভিন্ন ভিন্ন কুরবানি ওয়াজিব।
পরিবারের যত সদস্যের ওপর কুরবানি ওয়াজিব তাদের প্রত্যেককেই একটি করে পশু কুরবানি করতে হবে কিংবা বড় পশুতে পৃথক পৃথক অংশ দিতে হবে। একটি কুরবানি সবার জন্য যথেষ্ট হবে না।
মাসআলা : কুরবানির নেসাব পুরো বছর থাকা জরুরি নয়; বরং কুরবানির তিন দিন থাকলে এমনকি ১২ তারিখ সূর্যাস্তের কিছু আগে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে গেলেও কুরবানি ওয়াজিব হবে। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬।
মৃত ও জীবিতের পক্ষ থেকে কুরবানি
মাসআলা : মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানি করা জায়েজ। মৃত ব্যক্তি যদি অছিয়ত না করে থাকে তবে সেটি নফল কুরবানি হিসাবে গণ্য হবে। কুরবানির স্বাভাবিক গোশতের মতো তা নিজেরাও খেতে পারবে এবং আত্মীয়স্বজনকেও দিতে পারবে। আর যদি মৃত ব্যক্তি কুরবানির অছিয়ত করে গিয়ে থাকে তবে এর গোশত নিজেরা খেতে পারবে না। গরিব-মিসকিনদের মাঝে সদকা করে দিতে হবে। -মুসনাদে আহমদ ১/১০৭, হাদিস ৮৪৫, ইলাউস সুনান ১৭/২৬৮, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৬, কাযীখান ৩/৩৫২।
মাসআলা : যেমনিভাবে মৃতের পক্ষ থেকে ঈসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে কুরবানি করা জায়েজ তদ্রূপ জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে তার ইসালে সওয়াবের জন্য নফল কুরবানি করা জায়েজ। এ কুরবানির গোশতদাতা ও তার পরিবারও খেতে পারবে। -রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৬।
কুরবানির সময়
মাসআলা : জিলহজ মাসের ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত মোট তিন দিন কুরবানির সময়। তবে সবচেয়ে উত্তম হলো প্রথম দিন কুরবানি করা। এরপর দ্বিতীয় দিন এরপর তৃতীয় দিন। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৮; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৫।
মাসআলা : যেসব এলাকার লোকদের ওপর জুমা ও ঈদের নামাজ ওয়াজিব তাদের জন্য ঈদের নামাজের আগে কুরবানি করা জায়েজ নয়। অবশ্য বৃষ্টি বাদল বা অন্য কোনো ওজরে যদি প্রথম দিন ঈদের নামাজ না হয় তাহলে ঈদের নামাজ আদায় পরিমাণ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম দিনেও কুরবানি করা জায়েজ।-সহিহ বুখারি ২/৮৩২, কাযীখান ৩/৩৪৪, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৮; সহিহ মুসলিম ২/১৫৪।
মাসআলা : যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগে কুরবানির পশু জবাই করবে সেটা তার নিজের জন্য সাধারণ জবাই হবে। আর যে নামাজ ও খুতবার পর জবাই করবে তার কুরবানি পূর্ণ হবে এবং সে-ই মুসলমানদের রীতি অনুসরণ করেছে। -সহিহ বুখারি ২/৮৩৪; সহিহ মুসলিম ২/১৫৪।
মাংস বণ্টন
মাসআলা : শরিকে কুরবানি করলে ওজন করে মাংস বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েজ নয়। -আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৭, কাযীখান ৩/৩৫১।
মাসআলা : কুরবানির গোশতের এক তৃতীয়াংশ গরিব-মিসকিনকে এবং এক তৃতীয়াংশ আÍীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দেওয়া উত্তম। অবশ্য পুরো গোশত নিজে রেখে দেওয়াও জায়েজ। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪, আলমগীরী ৫/৩০০।
কুরবানি করতে না পারলে
মাসআলা : কেউ যদি কুরবানির দিনগুলোতে ওয়াজিব কুরবানি দিতে না পারে তাহলে কুরবানির পশু ক্রয় না করে থাকলে তার ওপর কুরবানির উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। আর যদি পশু ক্রয় করেছিল, কিন্তু কোনো কারণে কুরবানি দেওয়া হয়নি তাহলে ওই পশু জীবিত সদকা করে দেবে। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৪, ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৫।
মাসআলা : কুরবানির দিনগুলোতে যদি জবাই করতে না পারে তাহলে খরিদকৃত পশুই সদকা করে দিতে হবে। তবে যদি (সময়ের পরে) জবাই করে ফেলে তাহলে পুরো গোশত সদকা করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে গোশতের মূল্য যদি জীবিত পশুর চেয়ে কমে যায় তাহলে যে পরিমাণ মূল্য হ্রাস পেল তা-ও সদকা করতে হবে। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০২, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২০-৩২১।
দরিদ্র ব্যক্তির কুরবানি
মাসআলা : নেসাব পরিমাণ সম্পদ নেই এমন দরিদ্র ব্যক্তির ওপর কুরবানি করা ওয়াজিব নয়; কিন্তু সে যদি কুরবানির নিয়তে কোনো পশু কিনে তাহলে তা কুরবানি করা ওয়াজিব হয়ে যায়। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯২।
যেসব পশু দ্বারা কুরবানি করা যাবে
মাসআলা : উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানি করা জায়েজ। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানি করা জায়েজ নয়। তদ্রূপ হাঁস-মুরগি বা কোনো পাখি দ্বারাও কুরবানি জায়েজ নয়। -কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫। আল্লাহ বলেন, আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানির নির্দেশ দিয়েছি। আল্লাহ তাদের রুজি হিসাবে যেসব গৃহপালিত পশু দিয়েছেন তার ওপর তারা যেন (জবাই করার সময়) আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে। -সূরা হজ : ৩৪।
কুরবানির পশুর বয়সসীমা
মাসআলা : উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানি করা জায়েজ। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে। উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানি জায়েজ হবে না। (কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬)।
জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, তোমরা (কুরবানির জন্য) মুসিন্নাহ ব্যতীত জবাই করো না। (মুসিন্নাহ হলো, ৫ বছর বয়সি উট, ২ বছরের গরু ও ছাগলের ক্ষেত্রে ১ বছর [শরহুন নববী]) যদি সম্ভব না হয় তবে ছয় মাস বয়সি ভেড়া বা দুম্বা। -সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৯৬৩।
অংশীদারি কুরবানি
মাসআলা : একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা শুধু একজনই কুরবানি দিতে পারবে। এমন একটি পশু দুই বা ততোধিক ব্যক্তি মিলে কুরবানি করলে কারোটাই সহিহ হবে না। আর উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাতজন শরিক হতে পারবে। সাতের অধিক শরিক হলে কারো কুরবানি সহিহ হবে না। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৩১৮, মুয়াত্তা মালেক ১/৩১৯, কাযীখান ৩/৩৪৯, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭-২০৮)।
জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের নির্দেশ করেছেন যে, আমরা একটি গরু এবং একটি উটে সাতজন করে শরিক হয়ে যাই। -সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১২১৮।
মাসআলা : যদি কেউ গরু, মহিষ বা উট একা কুরবানি দেওয়ার নিয়তে কিনে আর সে ধনী হয়, তাহলে তার জন্য এ পশুতে অন্যকে শরিক করা জায়েজ। তবে এতে কাউকে শরিক না করে একা কুরবানি করাই শ্রেয়। শরিক করলে সে টাকা সদকা করে দেওয়া উত্তম। আর যদি ওই ব্যক্তি এমন গরিব হয়, যার ওপর কুরবানি করা ওয়াজিব নয়, তাহলে যেহেতু কুরবানির নিয়তে পশুটি ক্রয় করার মাধ্যমে লোকটি তার পুরোটাই আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করে নিয়েছে, তাই তার জন্য এ পশুতে অন্যকে শরিক করা জায়েজ নয়। যদি শরিক করে তবে ওই টাকা সদকা করে দেওয়া জরুরি হবে। কুরবানির পশুতে কাউকে শরিক করতে চাইলে পশু ক্রয়ের সময়ই নিয়ত করে নিতে হবে। -কাযীখান ৩/৩৫০-৩৫১, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১০।
মাসআলা : সাতজনে মিলে কুরবানি করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। কারও অংশ এক সপ্তমাংশের কম হবে না। যেমন কারও আধা ভাগ, কারও দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরিকের কুরবানি সহিহ হবে না। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭।
মাসআলা : উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যে কোনো সংখ্যা যেমন-দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কুরবানি করা জায়েজ। -সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৩১৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭।
মাসআলা : কয়েকজন মিলে কুরবানি করার ক্ষেত্রে জবাইয়ের আগে কোনো শরিকের মৃত্যু হলে তার ওয়ারিশরা যদি মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানি করার অনুমতি দেয় তবে তা জায়েজ হবে। নতুবা ওই শরিকের টাকা ফেরত দিতে হবে। সেক্ষেত্রে তার স্থলে অন্যকে শরিক করা যাবে। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৯, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২৬, কাযীখান ৩/৩৫১।
কুরবানির পশুতে আকিকার অংশ
মাসআলা : কুরবানির গরু, মহিষ ও উটে আকিকার নিয়তে শরিক হতে পারবে। এতে কুরবানি ও আকিকা দুটিই সহিহ হবে। ছেলের জন্য দুই অংশ আর মেয়ের জন্য এক অংশ দিতে হবে। শৈশবে আকিকা করা না হলে বড় হওয়ার পরও আকিকা করা যাবে। যার আকিকা সে নিজে এবং তার মা-বাবাও আকিকার গোশত খেতে পারবে। -ইলাউস সুনান ১৭/১২৬।
মাসআলা : কুরবানি করতে হবে সম্পূর্ণ হালাল সম্পদ থেকে। হারাম টাকা দ্বারা কুরবানি করা সহিহ নয় এবং এক্ষেত্রে অন্য শরিকদের কুরবানিও সহিহ হবে না।
পশু কেনার পর ত্রুটি দেখা দিলে
মাসআলা : কুরবানির নিয়তে ভালো পশু কেনার পর যদি তাতে এমন কোনো দোষ দেখা দেয় যে কারণে কুরবানি জায়েজ হয় না তাহলে ওই পশুর কুরবানি সহিহ হবে না। এর স্থলে আরেকটি পশু কুরবানি করতে হবে। তবে ক্রেতা গরিব হলে ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারাই কুরবানি করতে পারবে। -খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩১৯, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬, ফাতাওয়া নাওয়াযেল ২৩৯, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৫।
পশু জবাই
মাসআলা : কুরবানির পশু নিজে জবাই করা উত্তম। তবে অন্যকে দিয়েও জবাই করাতে পারবে। এক্ষেত্রে কুরবানিদাতা পুরুষ হলে জবাইস্থলে তার উপস্থিত থাকা ভালো। -মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২২৬৫৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২২-২২৩, আলমগীরী ৫/৩০০, ইলাউস সুনান ১৭/২৭১-২৭৪।
মাসআলা : অনেক সময় জবাইকারীর জবাই সম্পন্ন হয় না, তখন কসাই বা অন্য কেউ জবাই সম্পন্ন করে থাকে। এক্ষেত্রে অবশ্যই উভয়কেই নিজ নিজ জবাইয়ের আগে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ পড়তে হবে। যদি কোনো একজন না পড়ে তবে ওই কুরবানি সহিহ হবে না এবং জবাইকৃত পশুও হালাল হবে না। -রদ্দুল মুহতার ৬/৩৩৪।
জরুরি মাসআলা
মাসআলা : কুরবানির গোশত অন্য ধর্মাবলম্বীকে দেওয়া জায়েজ। -ইলাউস সুনান ৭/২৮৩।
মাসআলা : কুরবানির পশু যদি চুরি হয়ে যায় বা মরে যায়, আর কুরবানিদাতার ওপর পূর্ব থেকে কুরবানি ওয়াজিব থাকে তাহলে আরেকটি পশু কুরবানি করতে হবে। গরিব হলে (যার ওপর কুরবানি ওয়াজিব নয়) তার জন্য আরেকটি পশু কুরবানি করা ওয়াজিব নয়। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬, খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩১৯।
মাসআলা : জবাইকারী, কসাই বা কাজে সহযোগিতাকারীকে চামড়া, গোশত বা কুরবানির পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া জায়েজ হবে না। অবশ্য নির্ধারিত পারিশ্রমিক দেওয়ার পর পূর্ব চুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসাবে গোশত বা তরকারি দেওয়া যাবে। -আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২৮।
মাসআলা : কুরবানিদাতার জন্য নিজ কুরবানির গোশত খাওয়া মুস্তাহাব। -সূরা হজ ২৮, সহিহ মুসলিম ২২/১৫৯, মুসনাদে আহমদ, হাদিস ৯০৭৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪।
মাসআলা : কুরবানি ওয়াজিব এমন ব্যক্তিও ঋণের টাকা দিয়ে কুরবানি করলে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। তবে সুদের ওপর ঋণ নিয়ে কুরবানি করা যাবে না।
মাসআলা : সামর্থ্যবান ব্যক্তির রাসূলুল্লাহ (সা.) পক্ষ থেকে কুরবানি করা উত্তম। এটি বড় সৌভাগ্যের বিষয়ও বটে। নবি কারিম (সা.) আলী (রা.)কে তার পক্ষ থেকে কুরবানি করার অছিয়ত করেছিলেন। তাই তিনি প্রতি বছর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পক্ষ থেকেও কুরবানি দিতেন। -সুনানে আবু দাউদ ২/২৯, জামে তিরমিযী ১/২৭৫।
মাসআলা : কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করতে চাইলে মূল্য সদকা করে দেওয়ার নিয়তে বিক্রি করবে। সদকার নিয়ত না করে নিজের খরচের নিয়ত করা নাজায়েজ ও গুনাহ। নিয়ত যা-ই হোক বিক্রয়লব্ধ অর্থ পুরোটাই সদকা করে দেওয়া জরুরি। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০১, কাযীখান ৩/৩৫৪।
মাসআলা : ঈদুল আজহার দিন সম্ভব হলে প্রথম নিজ কুরবানির গোশত দিয়ে খানা শুরু করা সুন্নত। অর্থাৎ সকাল থেকে কিছু না খেয়ে প্রথমে কুরবানির গোশত খাওয়া সুন্নত। এ সুন্নত শুধু ১০ জিলহজের জন্য। ১১ বা ১২ তারিখের গোশত দিয়ে খানা শুরু করা সুন্নত নয়। -জামে তিরমিযী ১/১২০।
মাসআলা : কুরবানির পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া জায়েজ নয়। গোশতও পারিশ্রমিক হিসাবে কাজের লোককে দেওয়া যাবে না। অবশ্য এ সময় ঘরের অন্য সদস্যদের মতো কাজের লোকদেরও গোশত খাওয়ানো যাবে। -আহকামুল কুরআন জাস্সাস ৩/২৩৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪।
মাসআলা : কুরবানির পশু জবাই করে পারিশ্রমিক দেওয়া-নেওয়া জায়েজ। তবে কুরবানির পশুর কোনো অংশ পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া যাবে না।
-কিফায়াতুল মুফতি ৮/২৬৫।