হোসেন মনির ,কুমিল্লা।।
কুমিল্লায় পরকীয়া প্রেমের জেরে দুই শিশুকে হত্যার দায়ে ইয়াসমিন আক্তার (২৮) নামের এক নারীর মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। হত্যায় সহযোগিতা করায় মাজেদা বেগম নামে আরেক নারীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার (৩১ জানুয়ারি) দুপুরে জেলা দায়রা জজ আদালতের বিচারক রোজিনা খানম এ রায় দেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ইয়াসমিন আক্তার জেলার মুরাদনগর উপজেলার লাজৈর এলাকার বাবুল হোসেনের স্ত্রী। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত মাজেদা বেগম একই এলাকার সেলিম মিয়ার স্ত্রী। তারা সম্পর্কে চাচি শাশুড়ি এবং ভাতিজা বউ।
কুমিল্লার অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট. নূরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, লাজৈর গ্রামের প্রবাসী বাবুল হোসেনের স্ত্রী ইয়াসমিন আক্তার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে আসক্ত ছিলেন। ২০১৪ সালের ২১ এপ্রিল বিষয়টি দেখে ফেলায় প্রথমে ভুট্টাক্ষেতে নিয়ে প্রতিবেশী মো. বিল্লাল হোসেনের ছয় বছর বয়সী ছেলে আরাফাতকে হত্যা করেন। ওই সময় খুনের ঘটনা দেখে ফেলায় একই এলাকার শাহ আলমের ৭ বছর বয়সী ছেলে জসিমকেও ছুরি দিয়ে জবাই করে হত্যা করে মরদেহ খালে ডুবিয়ে দেন ইয়াসমিন। এ কাজে ইয়াসমিনকে সহযোগিতা করেন চাচি শাশুড়ি মাজেদা বেগম।পরে স্থানীয়রা বিষয়টি টের পেয়ে ইয়াসমিনকে আটক করে পুলিশে দেন। ইয়াসমিনকে সহযোগিতাকারী মাজেদা বেগম আত্মগোপন করেন। গত বছর র্যাব-১১ মাজেদা বেগমকে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার দুর্গম একটি পাহাড়ি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে।
কুমিল্লা কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক মুজিবুর রহমান জানান, রায় ঘোষণার সময় দণ্ডপ্রাপ্ত দুই নারী এজলাসে উপস্থিত ছিলেন। বিচারক ১৬ জন স্বাক্ষীর সাক্ষ্য শেষে এ রায় দেন। দণ্ডপ্রাপ্তদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। রায় শুনে এজলাসেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন দণ্ডপ্রাপ্তরা।
ওই বছরের ২১ এপ্রিল নিহত আরাফাতের বাবা বিল্লাল হোসেন মুরাদনগর থানায় ইয়াসমিন ও মাজেদাকে এক ও দুই নম্বর আসামি করে এবং অজ্ঞাতনামা ২-৩ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। কুমিল্লা জেলা ও দায়রা জজ তৃতীয় আদালতের বিচারক রোজিনা খানম আজ দুপুরে এ মামলার রায় দেন।আসামিপক্ষের আইনজীবী তাইফুর রহমান এবং শাহানা সুলতানা সোমা বলেন, ‘আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করব।’
উল্লেখ্য যে,২০১৪ সালের ২১ এপ্রিল লাজৈর গ্রামের মো. বিল্লাল হোসেনের ছেলে আরাফাত (৬) ও শাহ আলমের ছেলে জসিম (৭) নামে দুই অবুঝ শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি ইয়াছমিন বেগম আর গ্রেফতার মাজেদা দ্বিতীয় এজাহারনামীয় আসামি।
এ হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই মাজেদা বেগম পলাতক ছিলেন। উক্ত ঘটনায় ওই বছরের ২১ এপ্রিল মুরাদনগর থানায় ইয়াসমিনকে ১নং, মাজেদা বেগমকে ২নং ও অজ্ঞাত ২-৩ জনকে আসামি করে নিহত আরাফাতের পিতা বিল্লাল হোসেন বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
ঘটনার পর ৭ বছরের অধিক সময় ধরে রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিজের নাম বদলে কখনো গৃহকর্মী, কখনো গার্মেন্টকর্মী আবার কখনো মহিলা ওঝাঁর ছদ্মবেশে আত্মগোপন করেছিলেন মাজেদা বেগম। সর্বশেষ তিনি গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকের ছদ্মবেশে গা-ঢাকা দিয়ে ছিলেন।
কিন্তু করোনা মহামারীর প্রভাবে গার্মেন্টস কর্মী ছাঁটাই হওয়ায় চাকরি হারিয়ে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার পাহাড়বেষ্টিত ইউনিয়ন দক্ষিণ চিকনছড়ার দুর্গম পাহাড়ি গ্রাম বাগমারার রাবার বাগানের পাশে অবস্থিত ভাইয়ের বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন।
আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় কতিপয় দালালের মাধ্যমে ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনাও করেন মাজেদা বেগম। সম্প্রতি র্যাব-১১, সিপিসি-২, কুমিল্লা ক্যাম্প চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার দীর্ঘদিন ধরে পলাতক এই আসামিকে আটকে গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু করে।
প্রযুক্তির সাহায্যে এবং মাঠপর্যায়ে গোয়েন্দা নজরদারির সূত্র ধরে অবশেষে র্যাব মাজেদা বেগমের অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার দক্ষিণ চিকনছড়া ইউনিয়নের বাগমারা নামক দুর্গম পাহাড়ি গ্রামের একটি বাড়ি থেকে মাজেদা বেগমকে (৪৫) আটক করতে সক্ষম হয়।