ফিচার ডেস্ক:
নীরব ঘাতক কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। সারা বিশ্বে ৮৮ কোটি মানুষ কিডনি রোগে ভুগছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় দুই কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে না পেরে প্রতি বছর অর্থ লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে কিডনি রোগ মৃত্যুর কারণ হয়। শরীরের ছাকনির মতো কাজ করে কিডনি। শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে অতি দরকারি এই অঙ্গটি। তাতে গোলামাল হলেই হুমকির মুখে পড়বে জীবন। আপনার অজান্তেই ভেতরে ভেতরে শেষ করে দিতে পারে এই নীরব ঘাতক। তবে আগে থেকে বুঝতে পারলে কিডনি সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
মানুষের প্রধান রেচন অঙ্গ হলো বৃক্ক বা কিডনি। কিডনি মূত্রনালীর অংশ এবং রক্তের ফিল্টার হিসেবে কাজ করে। মানবদেহের উদরগহ্বরের পিছনের অংশে, মেরুদণ্ডের দুদিকে বক্ষপিঞ্জরের নিচে পিঠ-সংলগ্ন অবস্থায় দুটি বৃক্ক অবস্থান করে। প্রতিটি বৃক্ক দেখতে শিমবিচির মতো এবং এর রং লালচে হয়।
বছরের পর বছর, দিনের পর দিন কিডনি ঠিক এভাবেই ছাঁকনির কাজ করে চলে। লবণ, বিষ এবং অবাঞ্ছিত পদার্থ শরীরে ঢুকতে বাধা দেয়। কিন্তু কিডনি অকেজো হয়ে গেলে শরীরের ক্ষতিকর বর্জ্য রক্তে জমা হয়। তখন বেঁচে থাকাই মুশকিল।
কিডনির সমস্যা দেখা দিলে শরীরে আরও বেশ কিছু রোগের প্রকোপ বাড়ে। যার ফলে স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ার পাশাপাশি প্রাণহানিও হতে পারে। কোন কোন লক্ষণ দেখে কিডনির সমস্যা বোঝা যাবে, সেগুলো জেনে রাখা খুব জরুরি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কিডনির সমস্যা দেখা দিলে শরীরে আরও বেশ কিছু রোগের প্রকোপ বাড়ে। যার ফলে স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ার পাশাপাশি প্রাণহানিও হতে পারে। তাই কী কী কারণে কিডনির সমস্যা দেখা দিতে পারে, কোন কোন লক্ষণ দেখে কিডনির সমস্যা বোঝা যাবে, সেগুলো জেনে রাখা খুব জরুরি।
যেসব কারণে কিডনি রোগ হয় তার অন্যতম কারণ হলো ভেজাল খাদ্যসামগ্রী, অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, প্রস্রাবে প্রোটিন যাওয়া, কিডনিতে পাথর, ইনফেকশন, অনিয়মিতভাবে ব্যথার ওষুধ সেবন, পরিবেশগত।
শরীরে অন্য কোন রোগ বাসা বেঁধে থাকলে কিডনির সমস্যা দেখা দিতে পারে, তা জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, যাদের শরীরে ইতিমধ্যে মধুমেহ, উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা বা হাইপারটেনশন, বিভিন্ন হৃদরোগের সমস্যা রয়েছে, পরিবারে আরও কোনও সদস্যের কিডনির সমস্যা দেখা গিয়েছে এছাড়া ষাট বছরের উর্ধ্বের ব্যক্তিদের মধ্যে কিডনির সমস্যা দেখা দিতে পারে।
কিডনি ফেলিওর হলে শরীরে চুলকানি, পেশিতে টান ধরা, মাথা ঘোরা এবং বমি বমি ভাব, খিদে না পাওয়া, অতিরিক্ত প্রস্রাব পাওয়া কিংবা একেবারেই প্রস্রাব না হওয়া, শ্বাস নিতে সমস্যা, ঘুমের সমস্যা হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, যদি কোনও ব্যক্তির কিডনি আচমকা কাজ করা বন্ধ করে দেয়, তাহলে কোন কোন লক্ষণ দেখা দিতে পারে- তলপেটে ব্যথা, পিঠে ব্যথা, ডায়রিয়া, জ্বর, নাক থেকে রক্ত পড়া, ত্বকে নানা সমস্যা দেখা দেওয়া, বমি হওয়া।
কিডনি বিকল হলে প্রস্রাব করতে সমস্যা হয়। প্রস্রাবের সময় চাপও বোধ হয়। যদি অনেকক্ষণ ছাড়া ছাড়া প্রস্রাব হয় এবং প্রসাবের রং গাঢ় হয় বা যদি অস্বাভাবিক পরিমাণে প্রসাব হতে থাকে বা খুব ঘন ঘন ফ্যাকাশে রঙের প্রস্রাব হয়, ধরে নেয়া যায় কিডনি ঠিকমতো কাজ করছে না। রাতে ঘুমের সময় বারবার প্রস্রাব করতে ওঠাও, কিডনির সমস্যার লক্ষণ। ত্বকে ফুসকুড়ি বা র্যাশ শরীরে যখন অতিমাত্রায় টক্সিন জমে, অথচ কিডনি কাজ করতে পারে না, ত্বকে তখন ফুসকুড়ি বেরোয়। অন্যান্য চর্মরোগও দেখা যায়। ক্লান্তি চেপে বসবে সুস্থ কিডনি থেকে ইপিও (এরিথ্রোপোয়েটিন) হরমোন নিঃসৃত হয়।
এই হরমোন অক্সিজেন বহন করতে আরবিসি বা লোহিত রক্তকণিকাকে সাহায্য করে। কিডনি ফেলিওরে এই হরমোন নিঃসরণ কমে যাওয়ায় আরবিসিতে তার প্রভাব পড়ে। অল্প পরিশ্রমই ক্লান্ত করে দেয়। মস্তিষ্ক ও পেশিকেও প্রভাবিত করে। রক্তাল্পতারও একই লক্ষণ। শ্বাসকষ্ট কিডনির সমস্যার একটা কমন লক্ষণ। আরবিসি কমে যাওয়ার কারণে শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়। এর ফলে শরীরে, বিশেষত ফুসফুসে টক্সিন জমতে থাকে। মাথা ঘোরা ও মনোনিবেশ করতে সমস্যা শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি দুটি কারণে হতে পারে। অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা নয়তো কিডনি ফেলিওর। মস্তিষ্কে অক্সিজেনের জোগান কমে যাওয়ার কারণেই একাগ্রতা কমে যায়। স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়াও অস্বাভাবিক নয়। মাঝেমধ্যে মাথাও ঘুরবে।
যখন কিডনি কাজ করা বন্ধ করতে শুরু করে, তখন শরীরের বর্জ্য পদার্থ রক্তে মিশতে শুরু করে। এই বর্জ্য পদার্থের বেশির ভাগই হচ্ছে অম্লীয় পদার্থ। তাই এই বর্জ্য যখন রক্তের সঙ্গে ফুসফুসে পৌঁছায় তখন ফুসফুস সেই বর্জ্য বের করার জন্য কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করা শুরু করে। এ কারণে পর্যাপ্ত অক্সিজেন ফুসফুসে ঢুকতে পারে না। এতে শ্বাসকষ্টের সমস্যা হতে পারে।
কিডনি রোগ হলে গরম আবহাওয়ার মধ্যেও শীত শীত অনুভব হয়। আর কিডনিতে সংক্রমণ হলে জ্বরও আসতে পারে।
কিডনির সমস্যা আপনার চোখে ঝাপসা দেখা কিংবা মানসিক অস্থিরতার সৃষ্টি করতে পারে। কারণ শরীরের বর্জ্য পদার্থের একটি বড় অংশ হচ্ছে ইউরিয়া। কিডনির সমস্যার কারণে ইউরিয়া শরীর থেকে বের না হয়ে বরং রক্তে মিশে যায়। এই দূষিত রক্ত মস্তিষ্কে পৌঁছে মানসিক অস্থিরতা, ঝাপসা দেখা এই ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করে। যদি ইউরিয়ার পরিমাণ অত্যধিক হয় তাহলে তা মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে পারে, যার ফলাফলে রোগী কোমাতে পর্যন্ত চলে যেতে পারেন।
এই সমস্ত লক্ষণ দেখা দিলে একেবারেই ফেলে রাখা ঠিক নয় বলে মত বিশেষজ্ঞদের। যতটা সম্ভব দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে চিকিৎসা শুরু করা দরকার।
কিডনির রোগীদের খুব সাবধানে খাবার বাছাই করতে হয়। রোগীর রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি পর্যায়ে থাকে, তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা, কম লবণ দেওয়া খাবার, চিনি ও কৃত্রিম খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলুন। এছাড়া কার্বোহাইড্রেট সমৃ্দ্ধ খাবার এড়িয়ে চলুন। সবসময় ফলের রসের মতো প্রাকৃতিক মিষ্টি বা চিনি পান করুন। এছাড়া নিয়ম মেনে প্রতিটি মানুষের প্রতিদিন আধা ঘণ্টা করে হাঁটা উচিত।
কিডনি যাতে ঠিক মতো কাজ করতে পারে সেই কারণেই কিডনি পরিষ্কার রাখতে হবে। শরীরে যদি বিষাক্ত পদার্থ জমতে থাকে তাহলে রক্ত দূষিত হয়ে যায়। সেই সঙ্গে কিডনিতে পাথর, ফোলা ভাব, ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যা এসবও আসতে পারে। আর কিডনি যদি পরিষ্কার থাকে তাহলে ত্বকের অনেক সমস্যাও দূর হয়। এর জন্য রোজ প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতেই হবে। তেল, ঝাল, মশলা খেয়ে হাত তো ঠিকই ধুচ্ছেন, তবে কিডনি কি পরিষ্কার করছেন? হাতের কাছেই আছে এর সমাধান। কীভাবে পরিষ্কার করবেন? জেনে নিন, কিডনি পরিষ্কারের ঘরোয়া উপায়।
কিডনি পরিষ্কার করতে ধনেপাতার জুড়ি নেই। পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নিন এক আঁটি ধনেপাতা। এরপর কুচি কুচি করে কেটে একটি পাত্রে রাখুন। পাত্রে কিছুটা পানি দিয়ে ১০ মিনিট ফুটিয়ে নিন। ঠান্ডা হলে ছেঁকে পরিষ্কার বোতলে রেখে দেন। ফ্রিজেও রেখে দেয়া যেতে পারে ওই বোতল। এরপর প্রতিদিন একগ্লাস করে ধনেপাতার জুস খেলেই হাতেনাতে মিলবে ফল। কিডনির মধ্যে জমে থাকা লবণ এবং বিষাক্ত পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে বেরিয়ে যাবে।
লেবুর রসেও রয়েছে প্রচুর পরিমাণ সাইট্রিক অ্যাসিড। আর তাই লেবুর রস রক্তকে ফিল্টার করে এবং সেখান থেকে দূষিত পদার্থ অপসারণ করে। লেবুর রসে ক্যালশিয়াম অক্সালেট দ্রবীভূত হয়ে যায় যা কিডনি স্টোনের অন্যতম প্রধান কারণ।
কিডনি পরিষ্কার রাখতে এবং রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বজায় রাখতে খুব ভাল কাজ করে তুলসি পাতা। চায়ে তুলসি পাতা ফুটিয়ে খেতে পারেন। তুলসি পাতায় থাকা অ্যাসিটিক এসিডের কারণে কিডনির পাথর আস্তে আস্তে নরম হতে থাকে। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদানের কারণে এটি কিডনির স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো।
প্রতিদিন আপেল সিডার ভিনেগার খেতে পারেন। আপেল সিডার ভিনেগার শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এর ফলে রক্তশর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকে। সেই সঙ্গে রক্তচাপও কমে আর কিডনি ভাল থাকে। আপেল সিডার ভিনেগারের মধ্যে থাকে সাইট্রিক অ্যাসিড, যা পাথর গলিয়ে দিতে সাহায্য করে। সেই সঙ্গে সব টক্সিনও বেরিয়ে যায়।
আদা চায়ে রয়েছে অনেক স্বাস্থ্য সুবিধা। এটিও মুক্ত মৌল অপসারণের মাধ্যমে কিডনি রোগের সঙ্গে যুক্ত প্রদাহ হ্রাস করে। আদা ভালো করে ধুয়ে খোসা ছাড়িয়ে গরম পানিতে পাঁচ মিনিট ফুটাতে হবে। একে মিষ্টি স্বাদের করতে চাইলে একটু মধু মিশিয়ে পান করুন। এই চা সকালের দুর্বলতা ও কাশি দূর করতে সাহায্য করবে। এতে কোলেস্টেরল মাত্রা কম এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে দারুন কার্যকরী।
হলুদে রয়েছে চমৎকার স্বাস্থ্য সুবিধা। এটি অত্যন্ত শক্তিশালী একটি প্রদাহরোধী উপাদান। এ ছাড়া উপাদানটি দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের ফলে যে প্রদাহ সৃষ্টি হয় তা বন্ধ করে। হলুদ উচ্চ রক্তচাপ কমায় যা কিডনি রোগের দ্বিতীয় প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। যেহেতু এটি লিভার ফাংশনও উন্নত করে তাই হলুদের চা পান করলে এটি চমৎকারভাবে কিডনি পরিষ্কার করে। পানিতে এক চা চামচ হলুদের গুঁড়া মিশিয়ে ১০ মিনিট ফুটিয়ে নিন। এর সঙ্গে লেবু রস এবং গোল মরিচের গুঁড়া মিশিয়ে পান করুন।
কিডনি পরিষ্কার রাখতে বিট রসের জুড়ি নেই। পাশাপাশি এটি আপনার লিভার স্বাস্থ্যকে উন্নত করবে। এতে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা মুক্ত মৌলি দূর করে। বিট রস প্রস্রাবের অ্যাসিডিটি বৃদ্ধি করে যা কিডনিতে পাথর গড়ে ওঠায় দায়ী ক্যালসিয়াম অপসারণ করতে সাহায্য করে। বিট রস শরীরের রক্তকে পরিচ্ছন্ন করে তুলতে সহায়তা করে যা কিডনিকে পরিষ্কার রাখে।
রাজমার মধ্যে থাকে ভিটামিন বি, থাকে ফাইবার ও খনিজ পদার্থ। যা কিডনি পরিষ্কার করতে এবং মূত্রনালীর কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে। রোজ না হলেও সপ্তাহে অন্তত ২ দিন রাজমা খেতেই পারেন।
প্রতিদিন তরমুজ আর বেদানা খেতে পারলেও খুব ভাল। তরমুজের মধ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণ জল। এছাড়াও থাকে লাইকোপেন, পটাশিয়াম। যা কিডনির কার্যকারিতা বাড়ায়। সেই সঙ্গে প্রস্রাবের অম্লতা নিয়ন্ত্রণে রাখে। বেদানার রসেও প্রচুর পরিমাণ পটাশিয়াম থাকে। এছাড়াও থাকে অ্যাস্ট্রিনজেন্ট। যা কিডনিতে পাথর হতে দেয় না।