অনলাইন ডেস্ক:
২০২৫ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যেন চলছে এক অবসরের ঢল। বিশ্বের একাধিক বিখ্যাত ক্রিকেটার একে একে বিদায় জানাচ্ছেন লাল এবং সাদা বলের ফরম্যাটকে। এই ধারাবাহিকতায় ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে তৈরি হচ্ছে নস্টালজিয়া, পাশাপাশি উঠছে প্রশ্ন—একটি স্বর্ণযুগ কি তবে শেষের পথে?
চলতি বছর ভারতের দুই কিংবদন্তি বিরাট কোহলি ও রোহিত শর্মা টেস্ট থেকে অবসর নিয়েছেন। ওয়ানডে ক্রিকেট ছেড়েছেন অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার হেনরিখ ক্লাসেন। বাংলাদেশের এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব আল হাসান চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলে ওয়ানডে ও দেশের মাটিতে টেস্ট খেলে অবসর নিতে চাইলেও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। যদিও এরপর সাকিবকে জাতীয় দলের ডেরায় আর দেখা যায়নি।
রোহিত শর্মা
ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মা গত ৭ মে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি ইনস্টাগ্রামে একটি পোস্টে বলেন, ‘সবাইকে জানাতে চাই যে আমি টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিচ্ছি। সাদা পোশাকে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা আমার জন্য একান্ত গর্বের বিষয় ছিল। আপনাদের ভালোবাসা ও সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ। আমি ওয়ানডে ফরম্যাটে ভারতের হয়ে খেলা চালিয়ে যাব।’
রোহিতের টেস্ট ক্যারিয়ার এক নজরে
মোট টেস্ট ম্যাচ: ৬৭
মোট রান: ৪,৩০১
গড়: ৪০.৫৭
সেঞ্চুরি: ১২
হাফ-সেঞ্চুরি: ১৮
সর্বোচ্চ স্কোর: ২১২ (দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে, ২০১৯)
তিনি ভারতের হয়ে ১৬তম সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হিসেবে অবসর নেন।
রোহিতের অবসরের সিদ্ধান্তের পেছনে কয়েকটি কারণ উল্লেখযোগ্য:
ফর্মে পতন: শেষ ১৫ টেস্ট ইনিংসে মাত্র একটি হাফ-সেঞ্চুরি, গড় ১০.৯৩।
অস্ট্রেলিয়া সফরে ব্যর্থতা: ২০২৫ সালের শুরুর দিকে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ব্যর্থতা এবং সিডনি টেস্টে না খেলা।
নতুন চক্রের সূচনা: ২০২৫-২৭ ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের নতুন চক্র শুরু হওয়ার আগে অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
রোহিত শর্মা ওয়ানডে ফরম্যাটে খেলা চালিয়ে যাবেন এবং ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করবেন। তিনি ২০২৫ সালে ভারতের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং ভবিষ্যতেও দলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে থাকবেন।
ভারতের টেস্ট দলের ভবিষ্যৎ
রোহিতের অবসরের ফলে ভারতের টেস্ট দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসবে। শুভমান গিলকে নতুন টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, যিনি দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
বিরাট কোহলি
১৪ বছরের বর্ণাঢ্য টেস্ট ক্যারিয়ারের অবসান ঘটিয়ে এ বছরের ১২ মে আনুষ্ঠানিকভাবে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নেন ভারতের অন্যতম সেরা ব্যাটার বিরাট কোহলি। ক্রিকেটবিশ্বের জন্য এটি এক আবেগঘন মুহূর্ত, কারণ টেস্ট ক্রিকেটে কোহলির অবদান অনন্য ও অনস্বীকার্য।
এক ভিডিও বার্তায় কোহলি বলেন, ‘টেস্ট ক্রিকেট আমার কাছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে। এই ফরম্যাটে দেশের প্রতিনিধিত্ব করাটা ছিল স্বপ্নপূরণের মতো। এখন সময় হয়েছে নতুনদের সুযোগ দেওয়ার এবং আমি পাশে বসে ভারতের সাফল্য দেখতে চাই।’
একনজরে বিরাট কোহলির টেস্ট ক্যারিয়ার
মোট টেস্ট: ১২৩টি
মোট রান: ৯,২৩০
ব্যাটিং গড়: ৪৯.৩৪
সেঞ্চুরি: ৩০টি
হাফ-সেঞ্চুরি: ৩১টি
সর্বোচ্চ স্কোর: ২৫৪* (দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে, ২০১৯)
অধিনায়ক হিসেবে টেস্ট জয়: ৪০ ম্যাচ (ভারতের ইতিহাসে সর্বোচ্চ)
টেস্টে কোহলির অবদান
ভারতের সফলতম টেস্ট অধিনায়ক: তার নেতৃত্বে ভারত ঘরের মাঠে অপরাজেয় ছিল প্রায় এক দশক।
বিদেশে জয়: অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতকে ইতিহাস গড়তে সাহায্য করেন।
টেস্ট ক্রিকেটের দূত: আইপিএল ও টি-টোয়েন্টির যুগেও টেস্টের মর্যাদা ও আবেদন ধরে রাখায় বড় ভূমিকা রেখেছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
কোহলি এখন ওয়ানডে ফরম্যাটে মনোযোগ দিতে চান। তাছাড়া রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুকে ২০২৫ আইপিএল জিতিয়ে নিজের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্যারিয়ারে নতুন মাইলফলক গড়েছেন তিনি।
এক নায়কের বিদায়
বিরাট কোহলির অবসরের মধ্য দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটের এক সোনালি অধ্যায়ের অবসান হলো। তার ব্যাটিং, নেতৃত্ব এবং টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি আবেগ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জোগাবে বহু বছর।
সাকিব আল হাসান
বাংলাদেশের কিংবদন্তি অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান ২০২৪ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ভারতের কানপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। তিনি জানান, আগামী অক্টোবরে ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচটি (মিরপুর টেস্ট) হবে তার শেষ টেস্ট ম্যাচ। এছাড়া ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটিই ছিল তার শেষ আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি।
সাকিবের অবসরের ঘোষণায় বলেন, ‘আমার মনে হয়, টি-টোয়েন্টিতে আমার শেষ ম্যাচ খেলে ফেলেছি বিশ্বকাপে। মিরপুর টেস্টে খেলতে পারলে সেটি হবে আমার শেষ টেস্ট।’
তিনি আরও জানান, বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং নতুন খেলোয়াড়দের সুযোগ দিতে চান।
সাকিবের ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান
টেস্ট: ৭১ ম্যাচ, ৪,৬০৯ রান, ২৪৬ উইকেট
ওয়ানডে: ২৪৭ ম্যাচ, ৭,৫৭০ রান, ৩১৭ উইকেট
টি-টোয়েন্টি: ১২৯ ম্যাচ, ২,৫৫১ রান, ১৪৯ উইকেট
তবে জাতীয় দলে খেলতে না পারলেও বিশ্বব্যাপী ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলে যাচ্ছেন সাকিব। তিনি সম্প্রতি পাকিস্তান সুপার লিগজয়ী (পিএসএল) লাহোর কালান্দার্স দলের সদস্য ছিলেন।
গ্লেন ম্যাক্সওয়েল
অস্ট্রেলিয়ার তারকা অলরাউন্ডার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ২ জুন ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। যার মাধ্যমে তার ১৩ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটেছে।
ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যান
মোট ম্যাচ: ১৪৯
মোট রান: ৩,৯৯০
ব্যাটিং গড়: ৩৩.৮১
সেঞ্চুরি: ৪টি (সর্বোচ্চ: ২০১*, আফগানিস্তানের বিপক্ষে, ২০২৩ বিশ্বকাপ)
হাফ-সেঞ্চুরি: ২৩টি
উইকেট: ৭৭টি
স্ট্রাইক রেট: ১২৬.৭ (২,০০০+ রান করা খেলোয়াড়দের মধ্যে সর্বোচ্চ)
উল্লেখযোগ্য অর্জন
২০১৫ ও ২০২৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য।
২০২৩ বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ২০১* রানের অবিশ্বাস্য ইনিংস, যা ওয়ানডে ইতিহাসের অন্যতম সেরা হিসেবে বিবেচিত।
অবসরের কারণ
ম্যাক্সওয়েল জানান, ২০২২ সালে পায়ে চোট পাওয়ার পর থেকে ওয়ানডে ফরম্যাটে খেলা তার জন্য শারীরিকভাবে কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, ‘আমি অনুভব করছিলাম যে দলের জন্য যথাযথ অবদান রাখতে পারছি না, তাই নতুন প্রজন্মের জন্য জায়গা করে দেওয়াই সঠিক সিদ্ধান্ত।’
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ম্যাক্সওয়েল টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে খেলা চালিয়ে যাবেন এবং ২০২৬ সালে ভারতে অনুষ্ঠিতব্য টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের লক্ষ্য রাখছেন।
হেনরিখ ক্লাসেন
দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটকিপার-ব্যাটার হেনরিখ ক্লাসেন ৩৩ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। ২০২৫ সালের ২ জুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক আবেগঘন বার্তায় তিনি জানান, পরিবারকে আরও সময় দেওয়ার জন্য এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ক্লাসেনের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার এক নজরে
মোট ম্যাচ: ১২২টি
টেস্ট: ৪ ম্যাচ, ১০৪ রান
ওয়ানডে: ৬০ ম্যাচ, ২,১৪১ রান, গড় ৪৩.৬৯, স্ট্রাইক রেট ১১৭.০৫, ৪টি সেঞ্চুরি, ১১টি হাফ-সেঞ্চুরি
টি-টোয়েন্টি: ৫৮ ম্যাচ, ১,০০০ রান, স্ট্রাইক রেট ১৪১.৮৪
তিনি ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক অভিষেকের পর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার সাদা বলের ক্রিকেটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বিশেষ করে ২০২৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপ, ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং ২০২৫ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে দলের সাফল্যে তার অবদান উল্লেখযোগ্য।
অবসরের কারণ ও প্রতিক্রিয়া
ক্লাসেন বলেন, `পরিবারের সঙ্গে আরও সময় কাটানোর জন্য আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটি কঠিন সিদ্ধান্ত হলেও আমি শান্তি অনুভব করছি।‘
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেও ক্লাসেন বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লিগে খেলা চালিয়ে যাবেন। ২০২৫ আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে তার পারফরম্যান্স উল্লেখযোগ্য ছিল।