November 11, 2025, 5:36 pm
ব্রেকিং নিউজ

স্মৃতির পাতা ২০০২ সাল:কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার দৈ খাওয়ার চরে ভিজিটে

রিপোর্টারের নাম:
  • আপডেট টাইম Wednesday, October 22, 2025
  • 18 দেখা হয়েছে

রোকসানা বেগম:

২০০২ সাল, কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার দৈ খাওয়ার চরে ভিজিটে গিয়েছিলাম। আমি তখন হেড কোয়ার্টারে বসি। চর মানে কোন গাছ নেই, দোকান পাট, বাজার নেই।এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ির দূরত্ব অনেক বেশি। বেশিরভাগই খুব দরিদ্র লোকদের বসবাস ঐ এলাকায়। চৈত্র মাসের প্রচণ্ড গরম, সহ্য করতে পারছিলাম না।
একটি বাড়িতে ঢুকলাম। কোন গাছ নেই। দুইটি ঘর। একটি ঘর ৮ ফিট বাই ১২ ফিট হবে, ভাংগাচুরা। ইচ্ছে হলো ঘরটায় একটু ঢোকার। কংকালসার একজন মহিলা বসে আছে বাইরে।‌ তাই তাকে জিজ্ঞেস করলাম এই ঘরটা কার ? বললো হামাগের, পারমিশন নিয়ে ঘরটার ভিতরে ঢুকলাম,পাশে আরেকটা ঘর আছে,সেটা হচ্ছে যার ঘরে ঢুকলাম তার দেবরের।‌ ঐ ঘরটা একটু মন্দের ভালো। যাই হোক, যে ঘরে ঢুকলাম সেটার চতুরপাশে পাটকাঠি ও অন্যান্য অনেক পাতা এবং দুই একটা কলা পাতা দিয়ে ঘেরানো,উপরে পাটকাঠি ও পলিথিন দিয়ে ছাউনি। খুব নরবরে অবস্থায় আছে। ঢুকে মনে হচ্ছিল চিৎকার দিয়ে বলি “হে আল্লাহ” আপনি কি সত্যিই সাত আসমানের উপরে আছেন? ঘরের ভিতরে মাটিতে কিছু ধানের খর বিছানো,এটার উপর রাতে ওনারা ঘুমান। একটা মাটির পাতিল,একটা মাটির চামচ, একটা মাটির বড় গ্লাস একটা মাটির প্লেট (হানকা), একটা মাটির কলস, একটা ছেঁড়া কাঁথা খুঁটির সাথে বাঁধা দড়িতে ঝুলানো।
কংকালসার মহিলাটা তার তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে এখানে থাকেন।‌
স্বামী ধান কাটার মৌসুমে প্রতিবছর সিলেট অথবা কুমিল্লা যায়। ধান কাটার মৌসুম শেষ হলে টাকা নিয়ে আবার ফিরে আসে স্ত্রী সন্তানদের কাছে।‌ কিন্তু গতো তিন বছর আগে সে সিলেটে গিয়েছিল মৌসুমী ধান কাটার জন্য, আর ফিরে আসে নাই। মহিলা তার স্বামীর আর কোন খোঁজ খবর পায়নি। তখন না ছিল মোবাইল, না ছিল Internet, না ছিল বিকাশ।‌
যাই হোক প্রতিটি শিশু কংকালসার হয়ে আছে। বড় মেয়েটার বয়স হবে ১৩, ছেঁড়া একটা ফ্রগ পড়ে আছে। গা ঢাকার চেষ্টা করছিল। দ্বিতীয় মেয়েটার পড়নে একটা প্যান্ট ছিল। উপরে একটা ছেঁড়া ব্লাউজ, বাকী কারো গায়ে কোন কাপড় ছিলনা।‌ মহিলার পড়নে যে শাড়ীটি ছিল, সেটা গতো বছর নাগেশ্বরী গিয়ে জাকাতের কাপড় হিসেবে পেয়েছে।‌ শাড়ীটি ছিঁড়ে গেছে।
পেটিকোট বা ব্লাউজ কিছুই নেই। গোসল করার সময় অর্ধেক শাড়ী আগে ভিজিয়ে গুপটি মেরে বসে শুকিয়ে নেয়, তারপর বাকী অর্ধেকটা পড়ে গোসল সেরে শুকনো অর্ধেকটা হাত দিয়ে উপরে তুলে রাখে যাতে না ভিজে যায়। তারপর গোসল সেরে শুকনো কাপড়টা গায়ে পেঁচিয়ে বাকিটা ধুয়ে আবার বসে থাকে। শুকালে তারপর গা পেঁচিয়ে বাড়িতে ফিরে। এগুলো বসে বসে তার জায়ের কাছ থেকে শুনছিলাম। যখন শুনছিলাম তখন তিনি (কংকালসার মহিলাটা) বাড়িতে নেই। কোথায় যেন গিয়েছেন। কি করবো ভেবে উঠতে পারছিলাম না।‌ মহিলার কথাগুলি শুনছি আর হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল।‌ হঠাৎ ঐ মহিলা হাঁপাতে হাঁপাতে ঘামে ভিজে এসেই খড় দিয়ে চুলায় আগুন জ্বালিয়ে দিল। মাটির পাতিলটায় তিন কেজির মতো পানি দিলো। তার আঁচল থেকে এক মুঠো খুঁদ, হাঁড়িতে ঢেলে দিল।‌
ওনার সাথে কোন কথা বলার সাহস পাচ্ছিলাম না, প্রথমত তার মুখ দিয়ে কথা আসছে না,দ্বিতীয়ত সে তার যন্ত্রনায় অস্থির। তার জা কে জিজ্ঞেস করলাম এই খুঁদ কোথায় পেয়েছে? বললো কারো বাড়ি থেকে হয়তো এনেছে।
আজ দুইদিন বাচ্চাগুলি না খেয়ে আছে। আমি বললাম এক মুঠো খুঁদের সাথে এক হাঁড়ি পানি? জা বললো, তাও তো পেটে পানির সাথে কিছু একটা যাবে। পুরো গ্রামটায় একটা কলা গাছ নাই। তাই সে দুইদিন পর পর হেঁটে নাগেশ্বরী যায়, রাস্তার ধারের কলা গাছ কেটে টুকরো টুকরো করে ও কচুপাতা সহ অন্যান্য অনেক পাতা রাস্তা থেকে নিয়ে আসে। এগুলো সিদ্ধ করে দুই চার দিন সন্তানদের নিয়ে খায়। এভাবে গতো তিন বছর চলছে। জিজ্ঞেস করলাম আপনারা কিছু দেন না? বললো হামাগেরই চলে না। তাও প্রথম দিকে পারলে কিছু দিতো। এখন আর পারে না।
এদিকে চুলায় পানি বলক উঠছে, বড় মেয়েটা দুরে বসে আছে, বাকি তিন জন চুলা ঘিরে বসে আছে কখন পাতিলটা নামাবে। গরম পাতিল নামানো হলো। একজন প্লেট(হানকা), একজন গ্লাস নিয়ে বসে আছে,আরেকজনের হাতে কিছু নেই। কারন বাড়িতে আর কোন জিনিস নেই। প্লেটে ও গ্লাসে টলটলা পানি ভাতের মাড়ের কালারের মতো ঢেলে দিল দুই সন্তানকে মা নামক অসহায় কংকালটা। আরেকজন সন্তান চিৎকার করছে, মা বলছে ও খেয়ে সারলে প্লেটটা খালি হলেই দিবে। দুই দিন না খাওয়া শিশুর কি আর কোন তর সয় ? দুই জন এক টানে
গরম পানিটা লবন ছাড়া ঢক ঢক করে গিলে ফেলল। পরে বাকি দু’জন কে দিল। মা নামক কংকালটার ভাগে পড়লো এক কাপের মতো খুঁদের পানি।
আর চোখের পানি রাখতে পারছিলাম না। উঠে রাস্তায় আসলাম, একটা লোক নাই কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবো, হঠাৎ দেখি একজন ১১/১২ বছরের একটা ছেলে আসতেছে।‌ জিজ্ঞেস করলাম বাবা এদিকে কোন দোকান বা হাট আছে? বললো দুরে একটা দোকান আছে। হাট সপ্তাহে একবার বসে। জিজ্ঞেস করলাম দোকানে চাল ডাল পাওয়া যায়? বললো হ্যাঁ। আমি বললাম তোমাকে আমি ৫০ টাকা দিমু আমারে একটু খরচ কিনা দিবা ? ৫০ টাকার কথা শুনে ছেলেটির মুখে কি যে আনন্দ। হাসি দিয়ে বললো দেন আইনা দেই (রং পুরের ভাষায়) ব্যাগ খুলে দেখি আমার ব্যাগে মাত্র ৭৭০ টাকা আছে। ছেলেটির হাতে ৭০০ টাকা দিয়ে বললাম পাঁচ কেজি চাল, এক কেজি ডাল, এক কেজি পেঁয়াজ, এক কেজি লবন, তিন কেজি আটা, এক কেজি তেল আর ১২ টা ডিম এনে দিতে। বললাম টাকায় না হলে ডিম আনার দরকার নাই। এদিকে এতো ছোট ছেলে কি করে এতো কিছু আনবে ভাবছি। বার বার জিজ্ঞেস করছি তুমি পারবা বাবা ? সে বললো আমি মাথায় করে আনবো। বাবার সাথে সে আরো অনেক কঠিন কাজ করে বলে আমাকে শান্তনা দিলো। ছেলেটি এক দৌড় দিলো।
এবার মহিলার জা বললো এই ছেলে যদি খরচ নিয়ে না আসে? সে যদি ভেগে যায়? আমি বললাম দেখি কি হয়। বাচ্চারা কখনো এমন করে না। এই ফাঁকে আমি একটা কাজ মনিটরিং করতে গিয়েছিলাম,একটু দেখেই চলে আসছি আবার সেই বাড়িতে। বসে আছি তো আছি, আর রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছি।‌ হঠাৎ দেখা যাচ্ছে মাথায় এক ব্যাগ নিয়ে ছেলেটি আসছে। একটু এগিয়ে গেলাম, বাকিটা পথ ব্যাগটি আমি আনলাম। ছেলেটি সব খরচ করার পর আরো কিছু টাকা আমার হাতে ফেরত দিলো। আমি তাকে ৬০ টাকা দিলাম। সে কি যে একটা হাসি দিল। সে টাকাটা নিয়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে চলে গেল।‌ আমি ব্যাগটা এনে কংকালসার ভদ্র মহিলার হাতে তুলে দিয়ে বললাম এগুলো রান্না করে খান। আমার কাছে টাকা থাকলে আপনাকে আরো টাকা দিয়ে যেতে পারতাম।‌ যে টাকাগুলো ছিল সেগুলো হাতে গুঁজে দিলাম। মহিলা কান্না করে দিল, আপা আমার স্বামীরে আইন্না দেন না। (রং পুরের ভাষায়) হে মনে হয় আরেক জায়গায় বিয়া করছে,নইলে কই যাইবো? আমার সন্তানরা তার জান ছিল। আমি শান্তনা দিচ্ছি আর ভাবছি, হয়তো এমনো হতে পারে সে এক্সিডেন্ট করে মারা গেছে,আমি বললাম আপনি নামাজ পড়েন, আর আল্লাহকে বলেন। বেঁচে থাকলে হয়তো ফিরে আসতে ও পারে।‌ কতো রকম বিপদ হতে পারে। চিন্তা করবেন না আল্লাহর উপর ভরসা রাখেন। ভাবলাম এই জায়গায় আমি হলেই কি করতে পারতাম! তাকে মিছে কিছু শান্তনা দিলাম।
তারপর বিদায় নিয়ে চলে আসলাম। আমার গাড়ীর ড্রাইভার যেখানে রাস্তা শেষ সেখানে আমাকে নামানোর পর আমার জন্য এখোনো বসে আছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো গাড়িতে উঠলাম। গাড়িতে কোন কথাই বলিনি। কুড়িগ্রামে Guest Room এ নামলাম। সারারাত ঘুমাতে পারিনি,আজো ঐ দৃশ্য আমাকে তাড়া করে বেড়ায়।
জীবন কতো বিচিত্র। জীবনের কাছে মানুষ কতো অসহায়। এতো বছর পর ঐ দৃশ্যটা আজ খুব মনে পড়লো। কে জানে তার স্বামী ফেরত এসেছে কিনা, যদি না এসে থাকে কিভাবে কেটেছে তাদের এতো গুলি বছর? ওরাই বা বেঁচে আছে কিনা।
এই ঘটনা ২০০২ সালের। এখোনো গ্রাম গঞ্জের আনাচে কানাচে কতো অসহায় পরিবার আছে, যাদের অনেক ইতিহাস/কষ্ট আমরা কেউ জানি না।‌
আমি প্রতি নামাজে ওদের জন্য দোয়া করি।‌ ওরা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যুদ্ধ করেছে, মৃত্যুর পর যাতে আল্লাহ তায়ালা তাদের আর হিসাবে হিসাব না নেয়, এবং জান্নাত দান করেন।

শেয়ার করুন
এই ধরনের আরও খবর...
themesba-lates1749691102