
মমিনুল ইসলাম মোল্লা, কলামিস্ট, সাংবাদিক ও ঐতিহ্য বিষয়ক লেখক কুমিল্লা
ধর্ম, শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক অনন্য স্বাক্ষর বহনকারী একটি ঐতিহাসিক জনপদের নাম—এলাহাবাদ। কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার অন্তর্গত এ গ্রামটি শুধু তার সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের জন্যই নয়, নাগরিক সুবিধা, শিক্ষার প্রসার এবং সামাজিক উন্নয়নের দিক থেকেও জেলার মধ্যে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।সুফি সাধক হযরত শাহজালালের সফরসঙ্গীদের স্মৃতি বিজড়িত এই এলাকা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিতি পেয়েছে তার কৃতিসন্তানদের মাধ্যমে। ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এক সময় রাজনীতির অঙ্গনে বিশ্বপরিচিত নাম ছিলেন। বর্তমানে জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মোঃ আ. হান্নান এই গ্রামেরই সন্তান। এছাড়াও এলাহাবাদ ইউনিয়নের অসংখ্য মানুষ দেশ-বিদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিযুক্ত আছেন।
📍 ইউনিয়নের গঠন ও পরিসংখ্যান
এলাহাবাদ ইউনিয়নে রয়েছে মোট ১৪টি গ্রাম। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গ্রাম হল এলাহাবাদ, যার আয়তন ১,২৭০ একর। অন্যান্য গ্রামের আয়তন নিচে দেওয়া হলো: মোহাম্মদপুর – ৬১৪ একর,ফুলতলী – ৪৯০ একর,কাচিসাইর – ২৩২ একর,কুড়াখাল – ২১৩ একর,গৌরসার – ২০৬ একর,মগপুষ্কুরুনী – ২০৪ একর,ডালকরপাড়া – ১৪৬ একর,শুভপুর – ১৮৫ একর,শ্রীপুর – ১৩০ একর,পৈয়াবাড়ি – ১০২ একর,সিঙ্গারিকলা – ১৯৮ একর,বামনীসাইর – ৭৯ একর,হারসার – ৭০ একর।২০০১ সালের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এলাহাবাদ গ্রামের খানা সংখ্যা ছিল ১,৩০৭টি, জনসংখ্যা ছিল ৭,৪৪৩ জন এবং শিক্ষার হার ছিল ৫২.৭০%।অন্যদিকে গ্লোবাল কমিউনিকেশন সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, পুরো ইউনিয়নের আয়তন ৪,০৩৯ একর, জনসংখ্যা ২৫,১৪৩ জন, শিক্ষার হার ৫১% এবং বেকারত্বের হার ৪.৮৮%। শতকরা ৯৩.৯০% মানুষ নিরাপদ পানি ব্যবহার করে এবং ৪৩.৬২% মানুষের পয়নিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা রয়েছে।
🏫 শিক্ষার প্রসার
ক. প্রাথমিক শিক্ষা
এলাহাবাদে শিক্ষার বীজ বপন শুরু হয় বহু আগেই। অনীল চক্রবর্তীর দাদা রজনী বাবুর পাঠশালা সেই ঐতিহ্যের সূচনা করে। তবে আধুনিক প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখেন ছাদির বক্য ভূইয়া, যিনি ১৯৪৫ সালে ৩০ শতক জমি দান করে প্রথম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন।পরে আকামত আলীর উদ্যোগে ১৯৬৮ সালে এলাহাবাদ পূর্ব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১৯৭৩ সালে সীমারকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।বর্তমানে শিশুদের জন্য “এলাহাবাদ প্রভাতি কিন্ডারগার্টেন” এবং “উদয়ন কিন্ডারগার্টেন” সুনামের সঙ্গে চলছে।
খ. মাধ্যমিক শিক্ষা
১৯৪৮ সালে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের পিতা কেয়াম উদ্দীন ভূইয়ার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় এলাহাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টির রয়েছে ৫৩ শতক জমি। প্রতি বছর এখানকার শিক্ষার্থীরা কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিদ্যালয়ের সুনাম বৃদ্ধি করছে।
গ. উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা
১৯৯৫ সালে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ নিজ বাড়িতে এলাহাবাদ মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পরে কলেজটি স্থানান্তর করে এলাহাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের উত্তরে স্থাপন করা হয়। বর্তমানে মোঃ মফিজুল ইসলামের পরিচালনায় কলেজটি সুষ্ঠুভাবে চলছে।
ঘ. ধর্মীয় শিক্ষা
১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এলাহাবাদ ডিজেএস দাখিল মাদ্রাসা। এটি ৫৪ শতক জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে মোঃ দিদার বক্কর, আঃ গনি ও ক্যাপ্টেন সুজাত আলীর অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। এখান থেকে প্রতি বছর অসংখ্য ছাত্র দাখিল পাশ করে দ্বীনের খেদমতে নিয়োজিত হচ্ছে। ২০০৮ সালে গোলাম মোস্তফার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় আল-আমিন হাফেজি মাদ্রাসা ও এতিমখানা, যেখানে ৩০ জন ছাত্রের থাকা-খাওয়া ও পড়াশোনার ব্যবস্থা রয়েছে। তিনি একইসঙ্গে আল-আমিন বারিয়া কমপ্লেক্স, মসজিদ ও খানকাহ শরীফও প্রতিষ্ঠা করেন।
🏛️ অবকাঠামো ও নাগরিক সেবা
১. ডাক যোগাযোগ
১৯৩৯ সালে মোঃ সেকান্দর আলীর প্রচেষ্টায় এলাহাবাদে একটি শাখা ডাকঘর স্থাপিত হয়, যা এখনও গঙ্গামণ্ডল উপডাকঘরের অধীনে চালু রয়েছে।
২. বাজার
১৯৫৫ সালের ২১ ফাল্গুন (১৩৬২ বঙ্গাব্দ) এলাহাবাদ বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়। ৪৪ শতক জমির উপর এই বাজার গড়ে ওঠে। হোসেন উদ্দিনের এই বাজার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদান ছিল।
৩. চিকিৎসা সেবা
১৯৬৭ সালে ৩০ শতক জমির উপর একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয় জনাব জাফর চেয়ারম্যান ও আঃ ওয়াহেদের সহায়তায়। ডোনার হিসেবে আঃ ওয়াহাব মুহুরীর অবদান স্মরণীয়।
৪. ইউনিয়ন পরিষদ
১৯৮৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় ৭ নং এলাহাবাদ ইউনিয়ন পরিষদ। এর জন্য আরমান গাজী ৭ শতক জমি দান করেন। আবুল বাশার ভূইয়ার প্রচেষ্টায় এটি বাস্তবায়িত হয়।
৫. সমাজসেবা
১৯৮৬ সালে মনসুর আলী ও আঃ গনিসহ কয়েকজনের সহযোগিতায় শাহ জামাল-কামালের মাজার সংলগ্ন এলাকায় সমাজসেবা অফিসের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়
৬. এলজিডি গোডাউন
এখানে দুটি সরকারি গোডাউন রয়েছে। একটি বীজ সংরক্ষণের জন্য ৬ শতক জমির উপর, অপরটি ১৯৮৪ সালে আরমান গাজীর জমিতে নির্মিত হয়।
৭. ভূমি অফিস
এলাকাবাসীর সুবিধার্থে ১৯৮৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভূমি অফিস স্থাপন করা হয়।
⚡ বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ প্রযুক্তি
১৯৮০ সালের দিকে এলাহাবাদে পল্লী বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়। স্থানীয়দের অধিক মোবাইল ব্যবহারের ফলে এখানে গ্রামীণফোন ও একটেল মোবাইল টাওয়ার স্থাপন করা হয়।
মোঃ মোস্তাফিজের উদ্যোগে ১০০টিরও বেশি টেলিভিশনে ডিশ সংযোগ চালু করা হয়।
লোডশেডিং থেকে মুক্তির জন্য গাজী মার্কেটে জেনারেটর সার্ভিস চালু করেন এরশাদ।
মা টেলিকমের জুয়েল দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ চালু করেন এবং কলেজ রোডের কনিকা স্টুডিওতে ফটোকপির সুবিধা চালু হয়।
🚧 সড়ক অবকাঠামো
এলাহাবাদ এমন একটি গ্রাম যেখানে একটিও কাঁচা রাস্তা নেই—গ্রামের প্রতিটি সড়ক পাকা। উন্নয়নের এই চিত্র এলাহাবাদকে সত্যিকার অর্থেই দেবীদ্বার উপজেলার মধ্যে নাগরিক সুবিধাসম্পন্ন এক আদর্শ গ্রামে পরিণত করেছে।
সাংবাদিকতা: সাংবাদিক ও কলামিস্ট মমিনুল ইসলাম মোল্লার বাড়ি দেবিদ্ধার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে। তার দিক্ষা গুরু তার সহোদর বড় ভাই মনিরুল ইসলাম মোল্লা। তার পূর্বে এ গ্রামের কেউ সাংবাদিকতা করেছেন কিন ? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,হ্যা, আমার পূর্ও এলাহাবাদে সাংবাদিক ছিল ।আমার পূর্সূরীদের মধ্যে ছিলেন, হক কথা ও স্পোকসম্যান পত্রিকার সম্পাদক ফয়জুর রহমান ভূ্ইয়া, সাপ্তাহিক নতুন বাংলার সম্পাদক ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, এত্তফাকের স্টাফ রিপোর্টার অনীল চক্রবর্তী ও তার বড় ভাই নিউজ এসিস্টেন্ট বীজন চক্রবর্তী। এছাড়াও ছিলেন আব্দুল করিম ও সফিকুর রহমান ভূইয়া।
ঐতিহ্য, আধুনিকতা এবং নাগরিক উন্নয়নের এক অনন্য মিলনস্থল এলাহাবাদ। ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি এবং নাগরিক সেবার যে নিদর্শন এই গ্রামে রয়েছে, তা সত্যিই অনুকরণীয়। ভবিষ্যতে এই উন্নয়ন ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে এলাহাবাদ শুধু দেবীদ্বারের নয়—দেশের অন্যতম রোল মডেল গ্রামে রূপান্তরিত হবে, এ আশা করা যায়।
লেখক পরিচিতি: মমিনুল ইসলাম মোল্লা, কলামিস্ট, সাংবাদিক ও ঐতিহ্য বিষয়ক লেখক কুমিল্লা ।