
মমিনুল ইসলাম মোল্লা:
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ একটি যুগান্তকারী দলিল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এটি মূলত ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ও গণতান্ত্রিক জাগরণের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রণীত একটি রাষ্ট্রসংস্কারমূলক সনদ, যার কেন্দ্রে রয়েছে জনগণের সার্বভৌমত্ব, জবাবদিহিতা এবং ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কার ও গণতন্ত্র পুনর্গঠনের সম্ভাবনাময় এক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
জুলাই সনদের মূল বৈশিষ্ট্য কয়েকটি ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে উদ্ভাসিত।
প্রথমত, এটি ঘোষণা করে যে জনগণই রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক এবং সব ক্ষমতার উৎস। এই ধারণা আধুনিক গণতান্ত্রিক দর্শনের মূল চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
দ্বিতীয়ত, সনদটি সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন ও নির্বাচন প্রক্রিয়ায় মৌলিক সংস্কার আনার অঙ্গীকার করে। এতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি, দল বা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের ওপরে নয়—আইনই সর্বোচ্চ।
তৃতীয়ত, এতে মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দুর্নীতিমুক্ত শাসনের প্রতিশ্রুতি স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে।
চতুর্থত, ২০২৪ সালের আন্দোলনের শহীদ ও অংশগ্রহণকারীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি এতে অন্তর্ভুক্ত, যা ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রতীকী গুরুত্ব বহন করে।
সবশেষে, সনদ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় আইন, নীতি ও প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রতিশ্রুতি এই দলিলকে শুধু রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র নয়, বরং একটি সম্ভাব্য নীতি-দলিলে রূপ দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, জুলাই সনদকে অনেকে দক্ষিণ আফ্রিকার “Freedom Charter” (১৯৫৫) কিংবা তিউনিসিয়ার “National Dialogue Charter” (২০১৩)-এর সঙ্গে তুলনা করছেন। এই দুটি সনদ তাদের নিজ নিজ দেশে গভীর রাজনৈতিক সংকট নিরসনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় ফ্রিডম চার্টার বর্ণবৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক সংবিধান গঠনের পথ খুলে দেয়; তিউনিসিয়ায় ন্যাশনাল ডায়ালগ সনদ রাজনৈতিক সহিংসতা থামিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। বাংলাদেশের জুলাই সনদও যদি ঐক্যমূলক রাজনীতি ও আইনগত কাঠামোর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়, তবে এটি অনুরূপ পরিবর্তনের জন্ম দিতে পারে।
তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক মনে করেন, এই সনদ এখনো একটি নীতিগত প্রতিশ্রুতি, যার আইনি রূপ অনিশ্চিত। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ, প্রশাসনিক সংস্কারে প্রতিরোধ, এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক চাপ—সব মিলিয়ে বাস্তবায়ন জটিল হতে পারে। বিশেষত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীরা এর অগ্রগতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে, কারণ এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত।
অন্যদিকে, আশার দিকও রয়েছে। জুলাই সনদের মূল দর্শন—জনগণের ক্ষমতায়ন, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা—যদি দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে এটি শুধু বাংলাদেশের ভেতরেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক সংস্কার আন্দোলনের দিকনির্দেশক দলিল হয়ে উঠতে পারে। যেমন ম্যাগনা কার্টা ইংল্যান্ডে রাজকীয় ক্ষমতার সীমা টেনে দিয়েছিল, তেমনি জুলাই সনদও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে “জনগণ সর্বোচ্চ” নীতির ভিত্তি দৃঢ় করতে পারে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ কেবল একটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়; এটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের সম্ভাব্য নকশা। এর ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে রাষ্ট্র ও সমাজ কতটা আন্তরিকভাবে এই সনদের চেতনা বাস্তবায়ন করে—যদি সফল হয়, তাহলে এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের জন্য গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের নতুন মানচিত্র হিসেবে ইতিহাসে স্থান পাবে।
লেখক পরিচিতি -মমিনুল ইসলাম মোল্লা সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কুমিল্লা।।